মমতার দুর্গে এবার ফাটল ধরাতে পারবেন মোদী?

Published: 24 March 2024

পোস্ট ডেস্ক :


ভারতে ইদানিং বলা হচ্ছে যে, যেকোনও লোকসভা আসনে প্রার্থী যিনিই হোন না কেন, এবারের নির্বাচন হতে চলেছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বনাম মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী। পশ্চিমবঙ্গ দিদির রাজ্য। যেদিকেই তাকাবেন, সবদিকেই তাকেই দেখতে পাবেন।

প্রায় ১৩ বছর আগে, ২০১১ সালে ৩৪ বছর ক্ষমতায় থাকা বাম সরকারের বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক জয় পাওয়া মমতা ব্যানার্জী ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গের ৪২টি আসনের মধ্যে ৩৪টিতে জিতেছিলেন। তারপরে ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে জয়ী হয়ে নিজের স্থান আরও শক্তপোক্ত করতে সমর্থ হন তিনি। কিন্তু ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি ১৮টি আসন জিতে সবাইকে চমকে দিয়েছিল। আর এবছরের নির্বাচনে এনডিএ-র ৪০০ গণ্ডি পেরিয়ে যাওয়ার লক্ষ্য স্থির করেছে যে বিজেপি, তারা কি এবারও পশ্চিমবঙ্গে ২০১৯-এর মতো জয় ছিনিয়ে আনতে পারবে? বিশেষ করে যখন সন্দেশখালি, দুর্নীতি ও বেকারত্বের মতো বড় ইস্যু রয়েছে?

 

 

পূর্বাভাস কী বলছে?

একটি জনমত সমীক্ষায় বিজেপি ২৫টি আসন পাবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে, আর অন্য একটি সমীক্ষা বলছে তারা ১৯টি আসন পেতে পারে। তৃতীয় একটি সমীক্ষায় বলা হচ্ছে বিজেপি ২০টি আসনে জয়ী হতে পারে। বিবিসির সঙ্গে কথোপকথনে নির্বাচন বিশ্লেষক প্রশান্ত কিশোর বলেছেন যে, বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে ভাল ফল করতে পারে, অন্যদিকে তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষ দাবি করেছেন যে তৃণমূল কংগ্রেস ৩০-৩৫টি আসন পাবে।

বিজেপি মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্য দলের টার্গেট ৩৫ বলে জানালেও সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশ্যাল সায়েন্সেসের রাজনৈতিক বিশ্লেষক মইদুল ইসলাম মনে করেন না যে ‘বিজেপি তার অবস্থান শক্তিশালী করতে পারবে।’ ‘ইন্ডিয়া’ জোট থেকে বেরিয়ে এসে ৪২টি আসনেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা তৃণমূলের কাছে চ্যালেঞ্জ হল, যে সমালোচকদের এটা প্রমাণ করে দেখানো, যে তারা একাই প্রধানমন্ত্রী মোদীকে আটকাতে পারে। যদি দলটি তা করতে পারে, তা হলে দেশের বিরোধী নেতাদের মধ্যে মমতা ব্যানার্জীর মর্যাদা বাড়বে। তবে তা যদি না করতে পারে তৃণমূল কংগ্রেস, তাহলে নেতাদের দল থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা যেমন তৈরি হবে, তেমনই পরবর্তী বিধানসভা নির্বাচনে দলের সম্ভাব্য ফলাফল নিয়ে প্রশ্ন তোলার আশঙ্কাও তৈরি হতে পারে।

 

বিজেপি কি পারবে ২০১৯ -এর মতো ফল করতে?

কী হবে বলা মুশকিল, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে জেতার জন্য বিজেপি সবরকমের প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী মোদী ও অমিত শাহের ঘন ঘন সভা হচ্ছে, তৃণমূলের কয়েকজন শীর্ষ নেতার বিজেপিতে যোগ দেয়া আর বিজেপির প্রচারণা – জেতার জন্য কোনও চেষ্টাই বাদ রাখছে না বিজেপি। উত্তর ভারতে রাজনীতির শিখরে পৌঁছে যাওয়া বিজেপি জানে পশ্চিমবঙ্গ তাদের কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তাই তাদের এখানে ভাল করা গুরুত্বপূর্ণ। তবে বিজেপির কাছে চ্যালেঞ্জও কম নয়।

 

কলকাতায় বিজেপি নেতা শমীক ভট্টাচার্যের বাড়ির গেটে ক্যামেরা হাতে একদল সাংবাদিক জড়ো হয়েছিলেন ১৫ মার্চ সন্ধ্যায়। সামনে একটা উঁচু কাঠের টেবিলের ওপর এক গাদা মাইক রাখা। ভিতরে ঘরের দেওয়ালে লাগানো একটি টিভিতে দিল্লি বিজেপির সাংবাদিক সম্মেলন সরাসরি সম্প্রচার চলছিল। টিভির পর্দায় দেখানো হচ্ছিল তৃণমূল নেতা অর্জুন সিং এবং দিব্যেন্দু অধিকারীর দল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দেয়ার ছবি। দল বদল করা নেতাদের লম্বা তালিকা রয়েছে এই রাজ্যে।

 

সাংবাদিক সম্মেলন শেষ হওয়ার পরে ৪০ বছর ধরে সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত শমীক ভট্টাচার্য বলছিলেন, ‘অমিত শাহজি ৩৫টি আসনের কথা বলেছেন। আমরা এটিকে বাস্তবে রূপ দেয়ার জন্য কাজ করছি। মানুষ তৃণমূলকে প্রত্যাখ্যান করেছে।’ মনে করা হয়, ২০১৯-এর লোকসভা ভোটের বিজেপির ভাল ফলাফলের অন্যতম কারণ ছিল তৃণমূল-বিরোধী ভোট তাদের পক্ষে যাওয়ার ঘটনা।

 

বিশ্লেষক মইদুল ইসলামের মতে, ২০১৯ সালে বামদের প্রচুর ভোট বিজেপির দিকে গিয়েছিল এবং এর একটি বড় কারণ ছিল ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে তৃণমূলের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত অনিয়মের অভিযোগ উঠেছিল, যাতে মানুষ খুব ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিলেন। বিজেপিকে ভোট দেয়ার আরেকটি কারণ ছিল রাজনৈতিক কর্মীদের নিরাপত্তা দিতে পারে নি বাম এবং কংগ্রেস। তাই মানুষের সামনে বিকল্প ছিল সীমিত – সেজন্যই বিজেপিকে তারা বেছে নিয়েছিল।

 

তার মতে, বাম দলগুলির ভোট এখন আবার তাদের দিকেই ফিরছে, তাই বিজেপি তাদের আসন বাড়াতে পারবে বলে তিনি মনে করেন না। প্রবীণ সাংবাদিক শিখা মুখার্জীর মতে, কেউ ভাবেনি যে এত সংখ্যায় বামদের ভোট বিজেপির পক্ষে চলে যাবে।

 

বামদের কী অবস্থা?

সিপিএম অফিসে একটি ঘরে বসে চা খেতে খেতে মুহম্মদ সেলিমের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। ঘরের দেওয়ালে প্রয়াত বামপন্থী নেতাদের ছবি টাঙ্গানো আছে। দলের রাজ্য সম্পাদক সেলিম বলছিলেন, তাদের কাছ থেকে দূরে চলে গিয়েছিলেন যে ভোটাররা, গত দু’বছরে তাদের একটি অংশ ফিরে এসেছেন। এর প্রমাণ হিসাবে তিনি ২০২৩ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচন এবং ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের পরে যে কয়েকটি উপনির্বাচন হয়েছে, সেগুলির কথা উল্লেখ করছিলেন যেখানে বামদের ভোট বেড়েছে।

 

দলে নতুন প্রজন্মের নেতাদের সামনে নিয়ে আসা ভোট বৃদ্ধির একটা কারণ বলে তিনি মনে করেন। নতুন প্রজন্মের নেতাদের মধ্যে মীনাক্ষী মুখার্জীর নাম রয়েছে। সম্প্রতি বাম সংগঠন ডেমোক্রেটিক ইউথ ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়া আয়োজিত ‘ইনসাফ যাত্রা’ এবং কলকাতার ব্রিগেড ময়দানে বড় সমাবেশ করাকে বামপন্থীদের জন-ভিত্তি ফিরিয়ে আনার একটা প্রচেষ্টা বলে মনে করা হচ্ছে।

 

কিন্তু সাংবাদিক শিখা মুখার্জী মনে করেন না যে, লোকসভা ভোটে বামদের ভোট ফিরে আসবে। তিনি বলছিলেন সমাবেশের জমায়েতের সঙ্গে ভোটকে মেলানো ঠিক হবে না। অন্যদিকে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক প্রশান্ত কিশোরের যুক্তি, ক্ষমতার প্রতিটি স্তরে অর্থাৎ পঞ্চায়েত, বিধানসভা ও লোকসভায় তৃণমূলের আধিপত্যও দলের মাথাব্যথার একটা কারণ হয়ে উঠতে পারে। আবার সন্দেশখালির মতো ঘটনাতে ক্ষমতাসীন দলেরই ক্ষতি বেশি হয়।

 

বিজেপি সমর্থকরা অবশ্য আশা করেন যে সরকারের ওপরে দুর্নীতির গুরুতর অভিযোগ, বেকারত্ব বা সিএএ-র মতো ইস্যুগুলি থেকে তাদের দল ফায়দা তুলতে পারবে, আর তার মাধ্যমেই আসনও বাড়বে তাদের। আবার সিএএ, বা ৩৭০ ধারা অপসারণ বা রাম মন্দির নির্মাণ নিয়েও তারা তাদের ভোটারদের বলতে পারবেন যে তারা যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, সেগুলো পালন করেছেন।

 

বিজেপির কাছে চ্যালেঞ্জ

পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির সামনে চ্যালেঞ্জগুলির কথা উঠলে বারবার শোনা যায় যে এ রাজ্যে দিদির সঙ্গে পাল্লা দেয়ার মতো শক্তিশালী সংগঠন নেই, বড় জননেতা নেই বিজেপির। আর যারা আছে, তাদের অনেকে আবার তৃণমূল কংগ্রেস থেকে আসা নেতা। অনেকেই বলছেন, তৃণমূল কংগ্রেসের শক্তিশালী মাঠ পর্যায়ের সংগঠনের মোকাবিলা করা বিজেপির পক্ষে সহজ নয়।

 

পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির মুখ শুভেন্দু অধিকারী। মমতা ব্যানার্জীর ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত অধিকারী ২০২০ সালে তৃণমূলের একাধিক নেতার সঙ্গে বিজেপিতে যোগ দেন। এবার তার ভাই দিব্যেন্দু অধিকারী, অর্জুন সিং এবং তাপস রায়ও বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন। মইদুল ইসলাম বলছিলেন, ‘পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির কোনও জননেতা বা বড় নেতা নেই। তৃণমূল থেকে বিজেপিতে আসা শুভেন্দু অধিকারী তৃণমূল নেতাদের ব্যক্তিগত আক্রমণ করছেন। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের ভোটাররা রাজনৈতিকভাবে সচেতন। তারা ব্যক্তিগত আক্রমণ পছন্দ করে না।’

 

তার যুক্তি, “শুভেন্দু অধিকারী যখন তৃণমূল ছাড়েন, তখন তার জন-ভিত্তিটা পুরোপুরি বিজেপির দিকে যায়নি। এর একটা কারণ, সাধারণ মানুষ সহায়তা পাওয়ার জন্য রাজ্য সরকারের ওপরে নির্ভর করে থাকে। তারা মনে করেন, নতুন কেউ এলে তাদের সঙ্গে আবার নতুন করে বোঝাপড়া করতে হবে।“

 

ইসলামের কথায়, “পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা, বিহার – এই তিন রাজ্যে শ্রমিকের সংখ্যা বেশি। তারা সহায়তার জন্য রাজ্যের সরকারগুলির উপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। রাজনৈতিক সহিংসতাও এখানে বেশি কারণ অনেক মানুষকেই রাজনীতিবিদদের উপর নির্ভর করে চলতে হয়। তারা মনে করেন, নেতা চলে গেলে বা বদলে গেলে আমরা কীভাবে সরকারি সহায়তা পাব!”

 

শিখা মুখার্জীর মতে, বিজেপির কাছে বড় চ্যালেঞ্জ হল তারা এরাজ্যের কোনও আন্দোলনে যোগ দেয় নি, আবার রাম মন্দির আন্দোলনের কোনও প্রভাবও এ রাজ্যে না পড়ার মতো বিষয়গুলি। তিনি বলছিলেন ‘পশ্চিমবঙ্গ বিজেপির কাছে অচেনা। তারা বিরোধী দলের তকমা পেয়েছে, কারণ এখানে বাম ও কংগ্রেস দুর্বল হয়ে গেছে।‘

 

বিজেপি নেতা শমীক ভট্টাচার্য বলছিলেন, ‘দলে লোক তো নিতেই হবে, তারা আসবে সমাজ থেকেই। কেউ যদি আমাদের জাতীয়তাবাদ, সংস্কৃতি, এজেন্ডা মেনে চলে, তাহলেই আমরা দলে নিই। তার মানে এই নয় যে, বহিরাগতদের দিয়েই বিজেপি চলছে।’ তৃণমূল ও বামেদের তুলনায় বিজেপির সাংগঠনিক দুর্বলতা নিয়ে শমীক ভট্টাচার্য বলেন, ‘আমরা কোনও সাংবাদিককে সংগঠনের অবস্থা কী সেটা বলব না, তবে এই নির্বাচনে প্রতিটা বুথে আমাদের এজেন্ট থাকবে।’

 

বিজেপির কাছে আরেকটি চ্যালেঞ্জ হল, রাজ্যের প্রায় ৩০ শতাংশ মুসলমান ভোটারের একটা বড় অংশ তাদের থেকে অনেক দূরে থাকেন। এটা বলা ভুল হবে না যে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন চালু হওয়ার পরে ওই দূরত্ব কমেনি তো বটেই, বরং বেড়েছে। সূত্র: বিবিসি।