বিএনপি-জামায়াত মুখোমুখি
পোস্ট ডেস্ক :
এক সময়ের জোট শরিক বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের মধ্যে বাহাস শুরু হয়েছে। গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী নানা ইস্যুতে দল দু’টির মধ্যে তৈরি দ্বন্দ্বের বিষয়টি প্রকাশ পাচ্ছে নেতাদের বক্তৃতা-বিবৃতিতে। এ বছরের শুরুতে আওয়ামী লীগের একতরফা নির্বাচনের আগে থেকেই বিএনপি এবং জামায়াত আলাদা গন্তব্য বেছে নেয়। তবে দল দু’টির নেতারা পরস্পরকে নিয়ে খুব একটা নেতিবাচক কথা বলেননি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরকার পতনে একসুরে কথা বলতে দেখা গেছে। কিন্তু গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে যখন জাতীয় ঐক্য গড়ার আলোচনা চলছে তখন দুই দলের নেতারা কেন বাহাসে জড়াচ্ছেন তা নিয়ে নানা প্রশ্ন, নানা জিজ্ঞাসা। সূত্রের দাবি, চলমান পরিস্থিতিতে দলীয় স্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে কাজ করছে দল দু’টি। এ কারণে কিছু ইস্যুতে পরস্পরের মধ্যে সন্দেহ ও অবিশ্বাস তৈরি হয়েছে। বিএনপি নেতারা মনে করছেন, সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে রয়েছে জামায়াত। তারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে সুবিধা আদায় করে নিচ্ছে। এ ছাড়া আসন্ন জাতীয় নির্বাচন নিয়ে সরকারকে খুব একটা চাপ দিচ্ছে না জামায়াত। অন্যদিকে, বিএনপি চাইছে যত দ্রুত সময়ে সম্ভব নির্বাচন অনুষ্ঠান। দলটির নেতারা মনে করেন জামায়াত সরকারকে চাপ দিলে নির্বাচন আদায় সহজ হবে। কিন্তু দলটি সেদিকে যাচ্ছে না। এ ছাড়া সরকার যে সংস্কার উদ্যোগ নিয়েছে, তা জামায়াত অন্ধভাবে সমর্থন করছে। এই সংস্কারে কতোদিন লাগবে। কিভাবে বাস্তবায়ন হবে তার হিসাব কষছে না। এভাবে সংস্কারে অন্ধ সমর্থন দেয়া হলে নির্বাচন নিয়ে সরকার সময়ক্ষেপণ করতে পারে।
এ ছাড়া বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিজস্ব নিয়ন্ত্রণ নিয়েও দল দু’টির নেতাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে। স্থানীয় পর্যায়ে এ ধরনের ঘটনা বেশি ঘটছে।
ওদিকে সরকার পতনের পর বিএনপি’র স্থানীয় পর্যায়ের নেতাকর্মীরা দখল, চাঁদাবাজি ও মামলা বাণিজ্যে জড়িয়ে খবরের শিরোনাম হচ্ছেন। বিএনপি নেতারা মনে করেন এসব ঘটনা জামায়াতের পক্ষ থেকে প্রচার করে সুবিধা নেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। এসব ইস্যু সামনে আসায় নেতাদের মধ্যে বাদানুবাদ হচ্ছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকেও বিষয়টি নিয়ে পাল্টাপাল্টি পোস্ট দিচ্ছে দল দু’টি। চলছে নেতাদের মধ্যে কথার লড়াই। এরই অংশ হিসেবে রোববার জামায়াতের কড়া সমালোচনা করেছেন বিএনপি’র সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। এদিনই রিজভীর বক্তব্যের পাল্টা জবাব দিয়েছে জামায়াত।
৫ই আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সরকার পতনের পর থেকে বিএনপি ও জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের বক্তব্যে এবং কর্মসূচিগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বিএনপি দ্রুততম সময়ে সংস্কার শেষে নির্বাচনের দাবি জানাচ্ছে। বিপরীত অবস্থান নিয়েছে জামায়াত। দলটি আগে সংস্কার এরপর নির্বাচনের কথা বলছে। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের ক্ষেত্রেও বিএনপি’র চেয়ে জামায়াতের প্রভাব ছিল সবচেয়ে বেশি এবং সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানেও উচ্চ পদে বিএনপি’র চেয়ে জামায়াত ঘরনায় ব্যক্তিরা বসেছেন এমনটি দাবি করা হচ্ছে। সম্প্রতি বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সিদ্ধান্তও নেয়া হয় যে, অন্তর্বর্তী সরকার, জামায়াতে ইসলামী ও গণ আন্দোলনের ছাত্র নেতৃত্ব- এই তিনটি পক্ষের সঙ্গে এ মুহূর্তে কোনো ‘বিরোধ’ বা ‘বিবাদে’ জড়াবে না বিএনপি। ওদিকে এক অনুষ্ঠানে জামায়াতে ইসলামীর আমীর শফিকুর রহমান বলেন, জামায়াত ক্ষমতায় গেলে চাঁদাবাজ ও দুর্নীতিমুক্ত দেশ গড়া হবে। দেশে দখলবাজি ও চাঁদাবাজি চলবে না। দখলবাজ, চাঁদাবাজমুক্ত দেশ গড়তে নেতাকর্মীদের ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। পরে ২৯শে ডিসেম্বর রাজধানীর চন্দ্রিমা উদ্যানে সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে কোনো দলের কথা উল্লেখ না করে রুহুল কবির রিজভী বলেন, ৫ই আগস্টের আগে ব্যাংক লুট ও দখল করেছিল আওয়ামী লীগ আর এরপর একটি রাজনৈতিক দল ব্যাংক দখল করছে। আপনাদের একাত্তরের অর্জন কী? আপনারা একাত্তরের বিরোধিতা করেছেন। ইসলাম নিয়ে রাজনীতি করেন। ইসলাম মানে কি বারবার মোনাফেকি করা? ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে হাসিনাকে ক্ষমা করতে চান।
এদিন রুহুল কবির রিজভী ‘ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে হাসিনাকে ক্ষমা করতে চায় জামায়াত’ মর্মে যে বক্তব্য দিয়েছেন তা বিভ্রান্তিকর, ভিত্তিহীন ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে মন্তব্য করেছেন জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান। তিনি বলেন, রুহুল কবির রিজভী জামায়াতে ইসলামীর দিকে ইঙ্গিত করে বলেছেন, ‘৫ই আগস্টের পর একটি রাজনৈতিক দলের আত্মসাৎ দেখেছে জনগণ, কারা পায়ের রগ কাটে তাদের চেনে জনগণ, ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টা করছে একাত্তরের বিরোধিতাকারী জামায়াত।’ রিজভীর এ জাতীয় বক্তব্য বিগত কয়েক দশক ধরে প্রচার করা হচ্ছে। রগ কাটা, ঘোলা পানিতে মাছ শিকার, ৭১ এর বিরোধিতা এসব বক্তব্য জনগণ বহু পূর্বেই প্রত্যাখ্যান করেছে। পরে রাতে বিএনপি’র ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে জামায়াতে ইসলামীর বিবৃতির পাল্টা জবাব দেয় দলটি।
তবে বিএনপি’র সঙ্গে জামায়াতের কোনো দ্বন্দ্ব নেই বলে জানিয়েছেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন। মানবজমিনকে তিনি বলেন, এ নিয়ে বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির বৈঠকে কোনো আলাপ-আলোচনা হয়নি।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক এডভোকেট মতিউর রহমান আকন্দ মানবজমিনকে বলেন, বিএনপি নেতা (রুহুল কবির রিজভী) জামায়াতকে আক্রমণ করছেন। আমাদের অপবাদ দিয়েছেন। আমরা তার প্রতিবাদ করেছি।
১৯৯৯ সালের জাতীয় পার্টি, জামায়াতের তৎকালীন আমীর গোলাম আযম এবং ইসলামী ঐক্য জোটের তৎকালীন চেয়ারম্যান শায়খুল হাদিস আজিজুল হককে সঙ্গে নিয়ে চারদলীয় জোট গঠন করেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। পরবর্তীতে চার দলীয় জোট থেকে ২০ দলীয় জোট হয়। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকেই বিএনপি ও জামায়াতের সম্পর্কে টানাপড়েন দেখা দেয়। গত কয়েক বছর ধরেই দল দু’টির মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে এক প্ল্যাটফরম থেকে দল দু’টি আন্দোলন না করলেও বিএনপি’র যুগপৎ আন্দোলনের সঙ্গে মিল রেখেই কর্মসূচি পালন করেছে জামায়াত।