২১ আগস্টের প্রেক্ষাপট

বঙ্গবন্ধুর সাড়ে তিন বছরের স্বল্পস্থায়ী শাসনামলে এদেশে ৫০টিরও বেশি রাষ্ট্রীয় সফর অনুষ্ঠিত হয়। পাশাপাশি তার অনন্য সাধারণ নেতৃত্বের যোগ্যতায় তিনি নিজেকে নিয়ে গিয়েছিলেন এক অনন্য উচ্চতায়। বিশ্বের নেতৃস্থানীয় নেতৃত্বের সাথে সে সময় তার নাম উচ্চারিত হত। পাশাপাশি বাংলাদেশকেও তিনি উঠিয়ে এনেছিলেন উপরে উঠার সিড়িতে। পঁচাত্তরে বাংলাদেশের জিডিপি ছিলো ৭ শতাংশ উপরে। বাংলাদেশ এর পর এই জিডিপি ছুতে পেরেছে শুধু শেখ হাসিনার নেতৃত্বে, তার আগে কখনোই নয়। পাশাপাশি সে বছর ছিল বাম্পার ফলনের পূর্বাভাস। ৭৬’ এর বাংলাদেশের হওয়ার কথা ছিল অন্যরকম।
বাংলাদেশের এমনিতর সাফল্য কিন্তু মোটেও অপ্রত্যাশিত ছিল না। আজকের বাঙালি অধ্যুষিত যে ভূখণ্ড তার ইতিহাস হাজার বছরের। এমনটি বলার কারণ প্রথম বাংলা পাণ্ডুলিপি চর্যাপদের ইতিহাস ওই হাজার বছরেরই। ইতিহাস স্বাক্ষ্য দেয় এই দীর্ঘ সময় এই ভূখণ্ডের মানচিত্র বহুবার বদলেছে, বদলেছে শাসকরাও। আমরা শাসক হিসেবে পেয়েছি অনেককেই। এই দীর্ঘ তালিকায় ছিলেন এমনকি আফ্রিকার হাবসি ক্রীতদাসও। ছিলেন না কোন বাঙালি। পাল শাসনামলে বাংলা আর বাঙ্গালীর বিকাশ ইতিহাস স্বীকৃত। কিন্তু পাল রাজারা বাঙালি ছিলেন কিনা এ নিয়ে ঐতিহাসিকদের বিভক্তি আছে। যে সিরাজউদ্দৌলাকে আমরা বাংলার শেষ স্বাধীন শাসক বলে চিনতে শিখেছি তিনি ছিলেন অবাঙালি। পলাশীর প্রান্তরে সিরাজের বাহিনী যখন ক্লাইভের কাছে অসহায়ভাবে মার খাচ্ছিল, তখন আশেপাশের গ্রামবাসীরা তার সমর্থনে এগিয়ে আসলেও এই ভূখণ্ডের ইতিহাস হয়তো অন্যভাবে লেখার প্রয়োজন পড়তো। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটেনি। মানুষ মনে করেছিল এক বিদেশি শাসকের জায়গায় অন্য শাসক আসছে। এতে তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন হবে সামান্যই। একইভাবে কদিন আগেও যে ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজিকে আমাদের জাতির পিতা বানাবার চেষ্টা হয়েছিল সে ভদ্রলোকও আরব থেকেই এদেশে এসেছিলেন এদেশের সম্পদের লোভে।
বঙ্গবন্ধু শুধু হাজার বছরের মধ্যে বাঙ্গালী অধ্যুসিত কোনো ভূখণ্ডের প্রথম বাঙালি শাসকই নন, তিনি এই অঞ্চলের প্রথম জাতি রাষ্ট্রের স্বপ্নদ্রষ্টা এবং জনকও বটে। এক জাতির এক দেশ যে আজকের এই বাংলাদেশ তার উদাহরণ শুধু আমাদের অঞ্চলেই নয় বরং বিশ্বেই বিরল। বাঙালিদের সম্বন্ধে গোখলে বলেছিলেন, ‘বাঙালিরা আজকে যা ভাবে, তা অবশিষ্ট ভারত ভাবে আগামীকাল’। এমনি যে বাঙালি জাতি, তার কান্ডারি যদি হন বঙ্গবন্ধুর মতো অসম্ভব দূরদৃষ্টি সম্পন্ন, অনন্য সাধারণ একজন নেতা আর সেই জাতি যখন পায় তার নিজের দেশ, তখন তারা যে বিশ্ব কাপাবে- দাপাবে এমনটাতো প্রত্যাশিতই ছিল। এমন একটা দেশ সফল হোক তেমনটা কারো চাওয়াতেই থাকার কথা নয়। কাজেই একটি ১৫ আগস্ট মোটেও অপ্রত্যাশিত ছিল না। যা অপ্রত্যাশিত ছিল তা হলো কিছু বাঙালির হাতে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড। এমনটি কখনো বিশ্বাস করতে পারেননি জাতির পিতাও। যে কারণে তিনি নিজের মানুষগুলোর উপর আস্থা রেখেছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর অকাল প্রয়াণের পর বাঙালির আর বাংলাদেশের ইতিহাস শুধু পিছিয়ে চলার। পাকিস্তান অনুগত একের পর এক শাসক এসময় আমাদের শুধু মিথ্যাটা শিখিয়েছে আর ভুলটা বুঝিয়েছে। আমরা শিখেছি কোনো এক মেজরের এক ঘোষণায় হানাদার বাহিনীকে উড়িয়ে দিয়ে দেশ স্বাধীন করেছে আমাদের দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী। আমরা জয় বাংলা ভুলে আপন করেছিলাম বাংলাদেশ জিন্দাবাদকে আর বিশ্বমিডিয়ায় বানভাসি মানুষ কিংবা উড়ির চরের লাশের মিছিলে বাংলাদেশকে দেখে গর্বিত হতে শিখেছিলাম। সেই বাংলাদেশকে এই বাংলাদেশ বানাতে হলে দরকার ছিল বঙ্গবন্ধুর রক্তের উত্তরাধিকার আর সাথে তার হাতে গড়া সংগঠন, এ কথা আর কেউ না জানলেও জানতো তারা, যারা বাংলাদেশকে ব্যর্থরাষ্ট্রে পরিণত করতে ৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর থেকেই সক্রিয়। আর সে কারণেই ২১ আগস্ট। এবারের লক্ষ্য ছিলেন শেখ হাসিনা আর সাথে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব। স্রষ্টার অসীম কৃপায় সে যাত্রায় বেঁচে গেছে বাংলাদেশ। কারণ ১৫-এর মতন ২১-এর হামলাও কোনো ব্যাক্তি বা দলের বিরুদ্ধে নয়, এটা ছিল রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে।
২১ ব্যর্থ বলেই আজ সফল বাংলাদেশ। ৭৫’এ আবারো আমাদের প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশ ঘরে এবং কোভিডপূর্ব সময়টাতে তা ছিল ক্রমাগতই উর্দ্ধমুখি। আবারো দেশ আর আঞ্চলিকতার সীমানা পেরিয়ে বিশ্ব নেত্রী আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পদ্মার বুকে সেতু আজ যেমন স্বপ্ন নয় বাস্তবতা, তেমনি ৪১’এ উন্নত দেশে পরিনত হওয়ার বাংলাদেশের স্বপ্নও সম্ভবত তার আগেই বাস্তব হতে যাচ্ছে। ১৫ আগষ্টের কুশিলবরা আবার সক্রিয় হবে সেটাই স্বাভাবিক। এ কারনেই ১৫’র পর ২১ এসেছিল। ইদানিং এই করোনাকালে কিছুকিছু ঘটনা, কিছু ফিসফাস আর কারো-কারো অতি সক্রিয়তা কেন যেন সে রকমই ইঙ্গিত দেয়। অতএব আমরা যদি আবারো পিছনে হাটতে না চাই তাহলে একটু বাড়তি তর্কতার প্রয়োজন খুব বেশি।
লেখকঃ চেয়ারম্যান, লিভার বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়। সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ।