নারী, তুমি ঘুরে দাঁড়াও
।। নাজমা আক্তার রোজী।।
অনেকে মনে করেন, মানবসভ্যতার শুরু হয়েছিল মাতৃতান্ত্রিকভাবে। কিন্তু সময়ের বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আজ এটি পুরুষতান্ত্রিক হয়ে উঠেছে, হয়েছে। আর তখনই একশ্রেণির পুরুষ মনে করতে থাকে, মেয়েমানুষ হচ্ছে তাদের অন্য আর দশটা সম্পত্তির মতোই ভোগ্যপণ্য! তাই নারীকে যেমন ইচ্ছে তেমনভাবে ভোগ করার প্রবণতা সৃষ্টি হয়েছে।
পুরুষতান্ত্রিক সমাজ-সভ্যতার দৃষ্টিকোণে ধীরে ধীরে এটি স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। তখন নারীকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করে। যেমন, শত্রুকে চূড়ান্তভাবে অপমান-অপদস্ত করার একটি অনুষঙ্গ হলো প্রতিপক্ষের মা-বোনদের ধর্ষণ করা। আর এই ধর্ষণ-হত্যার মধ্যেই শত্রুপক্ষের পরাজয় বিবেচনা করা হতো, যা আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে ২ লাখেরও বেশি নারীর সম্ভ্রম বিনাশ করার মাধ্যমে পাকিস্তানি হানাদার ও রাজাকার বাহিনী—এই চেষ্টাই করেছিল। বর্তমান পরিস্থিতিও তার ব্যতিক্রম নয়। নারীকে ভোগ করতে নানা রকমের কৌশল নির্ণয় করে একশ্রেণির পুরুষ। করপোরেট হাউজ থেকে মিডিয়া হাউজগুলোতেও তার ব্যতিক্রম নয়।
আধুনিক সভ্যতায় এখন আর কোনো কিছু গোপন করার সম্ভবপর হয়ে ওঠে না। শুধু অপরাধের বিরুদ্ধে ঘুরে দাঁড়ানোর ইচ্ছাটা কাজে লাগাতে হবে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলতে হবে। এবার সেটা নিজ পরিবার-পরিজন কিংবা সমাজ-রাষ্ট্রের যে কোনো প্রতিষ্ঠানেই হোক। কিন্তু আমরা অনেকেই এখানে ‘নীরবে সহ্য’ করার নীতি গ্রহণ করি, যা যৌন-নিপীড়ক, ধর্ষকের পক্ষের অবস্থান সৃষ্টি হয়।
‘নীরব সহ্য’ করার মন-মানসিকতা থেকে নারীকেই বের হয়ে আসতে হবে। কারণ, একমাত্র নারীই বোঝে কোন কথায়, কোন ইশারায় ধর্ষণ কামনা-বাসনা নিয়ে পুরুষতান্ত্রিক কর্তৃত্ব তার সামনে হাজির হয়েছে। এখানে ভেরিফাইয়ের জন্য সময় দেওয়া যাবে না। ধর্ষক পুরুষকে দ্বিতীয়বার কী করতে হবে—এটা নারীকেই ঠিক করতে হবে। কারণ, নারী চাইলে সত্যিই অনেক কিছু করতে পারে, করার ক্ষমতা রাখে, যা ধর্ষক পুরুষ ঘুণাক্ষরেও চিন্তা করতে পারবে না।
গণমাধ্যমে জেনেছি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীর করা ধর্ষণ ও ধর্ষণে সহযোগিতার মামলায় গ্রেপ্তার ডাকসুর সাবেক ভিপির দুই সহকর্মীকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দুই দিনের রিমান্ডে পাঠিয়েছে আদালত। এটি সময় উপযোগী সিদ্ধান্ত। যদিও ঐ ছাত্রী জীবন-মরণ লড়াই করে, আমরণ অনশন থেকে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে গিয়ে কিছুটা সুস্থ হয়ে আবার আমরণ অনশনে বসেছে। রাষ্ট্রযন্ত্রের পুলিশ প্রথম দিকে উদাস-উদাস ভাব দেখালেও অবশেষে ধর্ষণের লিখিত মামলায় অভিযুক্ত মো. সাইফুল ইসলাম ও মো. নাজমুল হুদাকে গ্রেফতার করেছে।
এখানে সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হচ্ছে, এই মো. সাইফুল ইসলাম ও মো. নাজমুল হুদারা একটা সময় ধর্ষকের বিরুদ্ধে ধর্ষণবিরোধী সমাবেশে নিজেদের সহি-সাধু সাজানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেছে। শুধু তা-ই নয়, নিজেদের কলঙ্ক ঢাকার জন্য ঐ ছাত্রীর চরিত্র হনন করতে সোশ্যাল মিডিয়াকে বেছে নিয়েছে। কারণ, তাদের টাইমলাইন-ফেসবুক গ্রুপ জুড়ে লক্ষ লক্ষ ফলোয়ার। তাই নিজেদের পক্ষে সবাইকে না হোক, কতিপয় ফলোয়ারকে মাঠে নামানো যাবে, মাঠে-ঘাটে আন্দোলন হবে, মিছিল-মিটিং হবে, সেখানে ধর্ষকের বিরুদ্ধে নয় বরং ধর্ষিতার চরিত্র হনন করা হবে আর এতে মেয়েটা ভয়ে, আতঙ্কে ‘নীরব সহ্য’ করার ভূমিকা গ্রহণ করবে অথবা আত্মহত্যার পথ বেছে নেবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের ছাত্রী গত ২৩ সেপ্টেম্বর নারী ও শিশু নির্যাতন, অপহরণ করে ধর্ষণ ও সামাজিক যোগাযোগে মাধ্যমে চরিত্র হননের অভিযোগ এনে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে কোতোয়ালি থানায় মামলা করেন। আবার একই ঘটনায় দুই দিন আগে লালবাগ থানায় একটি মামলা করেই তিনি বসে থাকেননি, প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চেয়ে জাতীয় প্রেসক্লাবের চত্বরে (২৫ সেপ্টেম্বর) সংবাদকর্মীদের সামনে তার ওপর ঘটে যাওয়া যৌন নির্যাতনসহ ধর্ষণের ঘটনা তুলে ধরেছেন। আর পুলিশ প্রশাসন (১২ অক্টোবর) মো. সাইফুল ইসলাম ও মো. নাজমুল হুদাকে গ্রেফতার করেছে। আমরা আশা করছি, আদালত দ্বারা চূড়ান্ত প্রমাণ হবে—কে ধর্ষক আর কে কাকে প্রেমের ফাঁদ সৃষ্টি করে ধর্ষণ করেছে আর কে চরিত্রহীন।
তবে আমি মনে করি, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় বৈরী অবস্থান জানার পরেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের ঐ ছাত্রী যেভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন, সব যৌন নির্যাতন, নিপীড়কের বিরুদ্ধে অন্যান্য নারীকেও ঘুরে দাঁড়াতে হবে, অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে হবে। সয়ে যাওয়া নয়, সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতেই সবার আগে আমাদের নারীদের আওয়াজ তুলতে হবে। আবার এই নারীদেরই সমাজ সভ্যতায় আলো ছড়াতে সব অন্ধকার-কুসংস্কার ভেঙে মানবজাতিকে শিশুকাল থেকেই গড়ার গুরুদায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে।