মুক্তিযুদ্ধের অস্ত্র থাকুক মানুষের চোখের সামনে

Published: 6 November 2020

।। মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন ।।


আমেরিকায় ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনে ভোট গণনা প্রায় শেষ হয়ে আসছে। ডনাল্ড ট্রাম্প ও জো বাইডেনের মধ্যে কঠিন লড়াইয়ের আভাস দেখছিলাম প্রাথমিক ভোট গণনায়। সিএনএন ও বিবিসি’র অবিরাম ভোটের খবর থেকে চোখ ফেরানো কঠিন। করোনাভাইরাস মহামারীর এই সময়ে এ নির্বাচনে কী ফলাফল হবে শেষ পর্যন্ত, তা দেখতে টিভির পর্দায় নিবদ্ধ হয়ে আছে কোটি কোটি মানুষের চোখ। কারণ শুধু আমেরিকা নয়, গোটা বিশ্বের জন্য এই ফলাফল গুরুত্বপূর্ণ। নব্বইয়ের দশকে আমেরিকার পারডু বিশ্ববিদ্যালয়ে বন্যা সহনশীল ধান উদ্ভাবনের লক্ষ্যে বিজ্ঞানী থমাস কে হজেস- এর সাথে গবেষণা কাজ করেছি। এখন তিনি এমেরিটাস অধ্যাপক। মেসেঞ্জারে তার সাথে মত বিনিময় চলছিল। তিনি বললেন, “যদি ট্রাম্প জিতে যায়, তবে তা হবে আমাদের সবার পরাজয়”। আমেরিকায় এখন বেশ রাত। তাকে শুভরাত্রি জানিয়ে বলেছি, একটি ভিন্ন বিষয়ে লিখব, তাই আজকের মতো বিদায়।

ভুলে যাওয়া একটি খবর নিয়ে লিখব।

‘মুক্তিযুদ্ধের অস্ত্র বেঁচতে চায় সরকার’ শিরোনামে একটি খবর স্থানীয় একটি দৈনিকে প্রকাশিত হয় ৫ অক্টোবর, ২০২০ তারিখে। খবরে বলা হয়, “প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ, বাংলাদেশ সমরাস্ত্র কারখানা ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় মিলে এ নিয়ে কাজ করছে কয়েক বছর ধরেই।” … “প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ২০১৯ সালের ২৬ ডিসেম্বর ‘বিওএফে উৎপাদিত অস্ত্র ও গোলাবারুদ এবং মজুত অপ্রচলিত পুরোনো আগ্নেয়াস্ত্র রপ্তানিকরণ’ শীর্ষক একটি চিঠি দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে। এ চিঠির অনুলিপি দেওয়া হয় সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসারকেও।” চিঠিতে বলা হয়, “অস্ত্রগুলো বাংলাদেশের কেনা নয়। এগুলো মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বিভিন্ন উৎস থেকে সংগ্রহ করা ও বিভিন্ন বাহিনীর ফেলে যাওয়া, যা বিভিন্ন জায়গা থেকে পরিত্যক্ত হিসেবে সংগ্রহ করা হয়। এসব আগ্নেয়াস্ত্র বর্তমানে কার্যকর নয়, এমনকি যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করারও উপযুক্ত নয়।”

খবরে আরো বলা হয়, “সরকারের যুক্তি হচ্ছে এগুলো পুরোনো, অপ্রচলিত এবং যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে অকার্যকর। ফলে রাখার কোনো দরকার নেই। প্রাচীন নিদর্শন বা স্মৃতিচিহ্ন (অ্যান্টিক সুভ্যেনির) হিসেবে অস্ত্রগুলো কিনে নিতে আগ্রহ দেখিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের দুটি ও সুইজারল্যান্ডের একটি অস্ত্র আমদানিকারক কোম্পানি।”

খবরটি প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে সচেতন পাঠক মহলে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা গেছে। তবে খবরটি এখন বাসি হয়ে গেছে, কারণ তা প্রকাশিত হওয়ার পর ‘লম্বা’ এক মাস পেরিয়ে গেছে। আমরা বড় আত্মবিস্মৃত জাতি। খুব বেশিদিন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মনে রাখতে পারি না।

ভুলে যাওয়ার মতো খবর কিন্তু এটি নয়। সে সম্পর্কে অল্প কিছু কথা বলব।

যে অস্ত্রের কথা সরকার বলছে, তার সংখ্যা আট শ্রেণি মিলিয়ে মোট ২৭ হাজার ৬৬২টি। যার মধ্যে সবচেয়ে বেশি থ্রি নট থ্রি রাইফেল। মুক্তিযুদ্ধে গণবাহিনীর ব্যবহৃত অস্ত্র ছিল আলোচ্য অস্ত্রগুলো। থ্রি নট থ্রি রাইফেলই ছিল সবচেয়ে বেশি। একটি চিত্র আপনাদের সামনে তুলে ধরছি। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১, মুক্তি বাহিনী ও মিত্র বাহিনীর কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের পর বিজয়ী গণবাহিনীর প্রায় এক লাখ পঁয়তাল্লিশ হাজার সদস্য বাংলাদেশের অস্থায়ী ট্রানজিট ক্যাম্পগুলোতে নিজ নিজ অস্ত্র নিয়ে অবস্থান করছিল। এই অস্ত্র তাদের জীবনের চাইতেও বেশি দামী। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস ছাড়া বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ আর কখনো অস্ত্রের মালিক হয়নি। যুগে যুগে অস্ত্রধারীরা তাদের পদানত করেছে, তাদের ওপর কর্তৃত্ব করেছে। মুক্তিযুদ্ধের গণবাহিনীর সদস্যদের মনে বড় আশা মুক্তিযুদ্ধের অস্ত্র হাতে এবারে তারা হবে সদ্যমুক্ত বাংলাদেশের গণবাহিনীর সদস্য।

তেমনটা হওয়ার কথাও ছিল। বিজয়ের একেবারে ঊষালগ্নে ১৮ ডিসেম্বর ১৯৭১ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের জাতীয় মিলিশিয়া বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত বাস্তবতা শুধু নয়, বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা এবং ছাত্রদের এগারো দফায় ছিল পূর্ব পাকিস্তানের জন্য এমন একটি বাহিনী গড়ে তোলার দাবি। ২৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে ১১ সদস্য বিশিষ্ট জাতীয় মিলিশিয়া বোর্ড গঠন করা হয়। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে বোর্ডের সভাপতি ও মওলানা ভাসানী, মণি সিংহ, অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ এবং ৭ জন সংসদ সদস্যকে বোর্ডের সদস্য করা হয়। আওয়ামী লীগ ছাড়াও সে সময়ের অন্যান্য রাজনৈতিক দলের প্রধানদের যুক্ত রাখা হয়েছিল এই জাতীয় মিলিশিয়া বোর্ডে। ১৯৭২ সালের ৬ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মিলিশিয়া বোর্ডের প্রথম সভায় বলা হয়, ‘জাতি-ধর্ম-বর্ণ ও দলমত নির্বিশেষে যারা পাকিস্তান দখলদার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন, তাদের সবাইকে জাতীয় মিলিশিয়া বাহিনীতে নেয়া হবে।’

প্রায় একই সময়ে সেনা সদরে সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান জেনারেল এম এ জি ওসমানীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সেক্টর ও ফোর্স কমান্ডারদের এক সভায় মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে জাতীয় মিলিশিয়া বাহিনী গঠনের সরকারি সিদ্ধান্তের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানানো হয়। এবং এই কাজে সহায়তার জন্য উইং কমান্ডার এম কে বাশার, লে. কর্নেল সি আর দত্ত, লে. কর্নেল কাজী নুরুজ্জামান, লে. কর্নেল ডি কে দাশ, লে. কর্নেল এম এ মঞ্জুর এবং মেজর রফিকুল ইসলামকে নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়।

১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশে ফিরে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণের পরপর চূড়ান্তভাবে সরকারি সিদ্ধান্ত হয় জাতীয় মিলিশিয়া বাহিনী গঠন করবার। সেই মর্মে ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি এক সরকারি প্রেসনোটে ‘জাতীয় মিলিশিয়া বাহিনী’ গঠনের আট দফা নীতিমালা প্রকাশ করা হয়। পাঠকদের নজরে আনার জন্য তা নিচে তুলে ধরছি:

১. অবিলম্বে একটি জাতীয় মিলিশিয়া বাহিনী গঠন করা হইবে এবং তালিকাভুক্ত হউক বা না হউক, সমস্ত মুক্তিযোদ্ধাকে ইহার আওতায় আনা হইবে।

২. প্রত্যেক মহকুমায় সেই এলাকার গেরিলাবাহিনীর জন্য শিবির প্রতিষ্ঠা করা হইবে। শিবিরগুলির পরিচালনা ব্যবস্থা এমনিভাবে করা হইবে যেন এসব যুবককে পুনর্গঠন কাজের উপযোগী করিয়া প্রয়োজনীয় ট্রেনিং দেওয়া সম্ভব হয়।

৩. মহকুমা-ভিত্তিক শিবিরগুলি সেই এলাকার সমস্ত গেরিলাবাহিনীর মিলন-কেন্দ্র হইবে।

৪. উর্ধপক্ষে এগারোজন সদস্য লইয়া জাতীয় মিলিশিয়ার জন্য একটি কেন্দ্রীয় বোর্ড গঠন করা হইবে। বোর্ডের সদস্যগণকে সরকার মনোনয়ন দান করিবেন।

৫. প্রত্যেক মহকুমা-শহরে জাতীয় মিলিশিয়ার জন্য মহকুমা বোর্ড থাকিবে। মহকুমা বোর্ডের সদস্য সংখ্যা অনধিক এগারোজন হইবেন।

৬. প্রতিটি শিবিরে অস্ত্রশস্ত্র কার্যোপযোগী অবস্থায় রাখা, গুদামজাত করা ও হিসাবপত্র রাখার জন্য একটি করিয়া অস্ত্রাগার থাকিবে।

৭. ট্রেনিং-এর কার্যসূচি এমনভাবে প্রস্তুত করা হইবে যেন এসব যুবককে নিম্নে বর্ণিত ভূমিকা পালনের উপযোগী করিয়া তোলা যায়ঃ [ক] যেন তাহারা দেশের দ্বিতীয় রক্ষাব্যুহ হইতে পারেন; [খ] যখনই নির্দিষ্ট ভাবে প্রয়োজন হইবে তখনই যেন তাহারা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা ও পুনর্বহালে উপযোগী হইতে পারেন; [গ] দেশের পুনর্গঠন কার্যে সরাসরি সহায়তা হয় এমন বিভিন্ন কাজের উপযোগী হন।

৮. অস্বাস্থ্যকর বাসস্থান, অপুষ্টিকর খাদ্য এবং অপর্যাপ্ত বেতন ও ভাতার জন্য মুক্তিযুদ্ধের সময় এই গেরিলাদের এক বিরাট অংশ কষ্ট ভোগ করিয়াছেন। সেজন্যই তাহাদের খাদ্য, বাসস্থান, ও ভাতার প্রতি বিশেষ নজর দেওয়া হইবে।

এখানে থেমে গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতায় স্মরণ করছি হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে লড়াইয়ে রত বীর মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার উল আলম শহীদকে, যিনি রক্ষীবাহিনীর উপ-পরিচালক ছিলেন। তার রচিত ‘রক্ষীবাহিনীর সত্য মিথ্যা’ বইটি থেকে উপরের তথ্যগুলো সংগ্রহ করেছি। কায়োমনবাক্যে প্রার্থনা করছি এই লড়াইয়ে যেন তিনি জয়ী হন।

এবারে বিশেষভাবে উল্লেখ করছি যে, যখন জাতীয় মিলিশিয়া বাহিনীতে সকল মুক্তিযোদ্ধাদের অন্তর্ভুক্ত করার উপরের সরকারি নীতিমালা ঘোষণা করা হচ্ছে, তখন প্রায় একই সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র সমর্পন করার আহ্বান জানানো হয়। ১৯৭২ সালের ১৭ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু গণবাহিনীকে অস্ত্র জমা দেওয়ার নির্দেশ দেন। বাসসের সংবাদে বলা হয়েছিল, “এক বিবৃতিতে প্রধানমন্ত্রী জানান, এই বীর মুক্তিযোদ্ধাদের পুলিশ বাহিনী ও জাতীয় মিলিশিয়া বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী দেশ গড়তে গণবাহিনীর প্রচেষ্টা এবং পরবর্তী উদ্যোগগুলো নিয়ে কথা বলেন।” ২৪ জানুয়ারি, ১৯৭২ তারিখ যে দিন জাতীয় মিলিশিয়া বাহিনীর প্রজ্ঞাপন জারি হয়, সেই একই দিনে মুক্তিবাহিনীর অস্ত্র গ্রহণের জন্য বঙ্গবন্ধু টাঙ্গাইলে যান। সারা দেশে মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র সমর্পন করেন বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে।

এর পরপর দ্রুতলয়ে কিছু ঘটনা ঘটে যায়। রাষ্ট্র প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে পরাজিত পাকিস্তান রাষ্ট্রের সেই সব বাঙালি আমলাদের বসানো হয়, যারা ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর হয়ে বিশ্বস্ততার সাথে কাজ করে গেছে। যেমন, পুরো মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র সচিব পদে অত্যন্ত যোগ্যতার সাথে দায়িত্ব পালন করেছিলেন পুলিশ অফিসার আবদুল খালেক। তাকে না নিয়ে হানাদার বাহিনীর পক্ষে সুচারুভাবে কাজ করে যাওয়া তসলিম আহমদকে বসানো হয় অতি গুরুত্বপূর্ণ স্বরাষ্ট্র সচিব পদে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়েও একই অবস্থা। মুজিবনগর সরকারের সচিব নুরুল কাদের খানকে বাদ দিয়ে পাকিস্তান সরকারের সিএসপি কর্মকর্তা মো. জামানকে দেওয়া হয় গুরুত্বপূর্ণ সংস্থাপন সচিবের দায়িত্ব। আনোয়ার উল আলম শহীদ তার উপরে উল্লেখিত বইয়ে দুঃখ করে বলছেন, ‘এদিকে জাতীয় মিলিশিয়া গঠনের প্রজ্ঞাপন জারি হলেও অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে কোন অর্থ বরাদ্দ হয় না। … অর্থ মন্ত্রণালয়ে কোন ফাইল নড়ে না। অর্থ বরাদ্দ না হলে পিলখানায় জমায়েত হওয়া জাতীয় মিলিশিয়া সদস্যদের খাওয়া-দাওয়া করার ব্যবস্থা করা যাচ্ছে না। আবার সুব্যবস্থা না হলে দূর-দুরান্ত থেকে আসা মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করে একটা শৃঙ্খলার মধ্যে নিয়ে আসাও প্রায় অসম্ভব।’

এর মধ্যে ১৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭২ তারিখে ঢাকার পিলখানায় বিডিআর ও মিলিশিয়া বাহিনীতে যোগ দেওয়ার জন্য আসা মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ব্যাপক গোলযোগ ও গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। বঙ্গবন্ধুর হস্তক্ষেপে তা থামে বটে কিন্তু জাতীয় মিলিশিয়া বাহিনী গঠন আর হয় না। স্বাধীনতার ঊষালগ্নে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় যে জাতীয় মিলিশিয়া বাহিনী গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, মাত্র দু’মাসের ব্যবধানে তার করুণ অপমৃত্যু ঘটে। তার জায়গায় ১৯৭২ সালের ৮ মার্চ তারিখে ‘জাতীয় রক্ষীবাহিনী অর্ডার ১৯৭২’ জারি হয়। ইতোমধ্যে অস্ত্র জমা দেয়া নিঃস্ব, প্রতারিত মুক্তিযোদ্ধারা গভীর হতাশায় ফিরে গেছে ঠিকানাহীন জীবনে। স্বাধীন বাংলাদেশের একেবারে শুরুতেই পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রেতাত্মারা তাদের প্রথম এবং নির্ধারক জয়টি ছিনিয়ে নেয়।

নরওয়ের অসলো বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণারত আমাদের পুত্র ড. সানজীব হোসেন কয়েকদিন আগে ইউটিউবে সংরক্ষিত বঙ্গবন্ধুর একটি ভাষণের ভিডিও পাঠিয়েছে। ১৯৭৫ সালের ১১ জানুয়ারি তারিখে কুমিল্লা সেনানিবাসে বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি প্রাঙ্গণে অফিসার ক্যাডেটদের কুচকাওয়াজে বঙ্গবন্ধু এই অমর ভাষণটি দিয়েছিলেন। এই লেখার শেষে ভিডিওটির লিঙ্ক সংযুক্ত করবো এই আশায় যে পাঠকগণ বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের পাঠকেরা গভীর মনযোগে তা শুনবেন ও দেখবেন।

বঙ্গবন্ধু বলছেন নবীন অফিসারদের উদ্দেশ্যে, সিপাহীদের উদ্দেশ্যে। বলছেন, ‘তোমরা হচ্ছো আমার পিপলস আর্মি, আমার গণবাহিনীর সদস্য’। পরম মমতায় উপস্থিত সেনা সদস্যদের বোঝাচ্ছেন স্বাধীন বাংলাদেশে অফিসার-সিপাহীদের মধ্যকার সম্পর্ক, সেনাবাহিনীর সাথে জনগণের সম্পর্ক বিষয়ে। বলছেন, ‘তোমরা আমার প্রোডাক্টিভ আর্মি’। গভীর বিস্ময়ে স্মরণ করলাম এই কুমিল্লা সেনানিবাসে ১৯৭২ সালের জুলাই, অগাস্ট, সেপ্টেম্বর মাসে এ সব কথাই তো বলেছিলেন তৎকালীন স্টেশন কমান্ডার ও ৪৪তম ব্রিগেডের অধিনায়ক মুক্তিযুদ্ধে এক পা হারানো লে. কর্নেল আবু তাহের বীর উত্তম। শুধু বলা নয়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় জনগণের বাহিনী গড়ে তোলার প্রাথমিক কাজগুলো শুরু করে দিয়েছিলেন কুমিল্লা সেনানিবাসে। আরো মনে পড়ল কীভাবে বঙ্গবন্ধুর কান ভারী করা হয়েছিল তাহেরের ‘সন্দেহজনক অপতৎপরতা’ নিয়ে। যার কারণে সক্রিয় কমান্ড থেকে তাহেরকে সরিয়ে দেওয়া হয়। এবং তার প্রতিবাদে ১৯৭২ সালের ২০ সেপ্টেম্বর তারিখে বঙ্গবন্ধুকে লেখা ঐতিহাসিক পদত্যাগ পত্রে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে ধেয়ে আসা বিপদ সম্পর্কে গভীর শঙ্কা ব্যক্ত করে তাহেরের সেনাবাহিনী ছেড়ে দেয়া।

ভিডিওতে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ দেখে ও শুনে মনে হচ্ছিল আহা এই কথাগুলো যদি তিনি ৭২ সালে বলতেন! এখন তো ১৯৭৫ সাল। সেনাবাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা, রাষ্ট্রের সকল কেন্দ্রে মুক্তিযুদ্ধবিরোধীরা গেঁড়ে বসেছে। মঞ্চে বঙ্গবন্ধুর পাশে আছে পুরনো ষড়যন্ত্রকারী খোন্দকার মোশতাক। সশস্ত্র বাহিনীর প্রধানরা মঞ্চ আলো করে আছেন – এরা সবাই ষড়যন্ত্রের গুটি চালছেন বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে। আচ্ছা, কেমন হতো যদি স্বাধীন বাংলাদেশে রাষ্ট্র প্রশাসন ও সশস্ত্র বাহিনী গড়ে উঠত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে; মুক্তিযুদ্ধের গণবাহিনীর সদস্যদের নিরস্ত্র করার বদলে তাদের নিয়ে গড়ে তোলা হতো জাতীয় মিলিশিয়া বাহিনী; যদি কর্নেল তাহেরের মতো মানুষদের যথাযোগ্য স্থানে নিয়োগ করা হতো। পাঠক একবার ভেবে দেখুন, তাহলে কি পাকিস্তানের প্রেতাত্মাদের পক্ষে সম্ভব হতো বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভেতরে থেকেই বাংলাদেশের বিরুদ্ধে, জাতির জনকের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করবার? তাদের কি সাধ্য ছিল সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে, জাতীয় চার নেতা ও কর্নেল তাহেরকে হত্যা করার?

মুক্তিযুদ্ধের অস্ত্রের কথায় আবার ফিরে আসি। এই অস্ত্রগুলো থাকুক বাংলাদেশের মানুষের চোখের সামনে। যেমনটা বলা হয়েছিল জাতীয় মিলিশিয়া বাহিনীর প্রজ্ঞাপনে। প্রতিটি উপজেলায় প্রতিটি থানার সামনে দৃষ্টিনন্দন সুরক্ষিত কাঠামোতে সাজানো থাকুক অস্ত্রগুলো। মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে এখনো যারা বেঁচে আছেন, তাদের এই সান্ত্বনাটুকু থাকুক, যে অস্ত্র তাদের কাছ থেকে নিয়ে নেওয়া হয়েছিল, সেগুলো আবার ফিরে এসেছে তাদের চোখের সামনে। নতুন প্রজন্ম পরম মমতায় চোখ মেলে দেখুক হাজার বছরের ইতিহাসে প্রথমবারের মত গণমানুষের হাতে আসা অস্ত্রগুলো। আর মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কীটেরা গর্তের ভেতরেই থাকুক। কারণ মাথা বের করলেই তাদের চোখে পড়বে গ্রাম বাংলার মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে উদ্যত এই সব অস্ত্রের ছবি। মনে পড়বে তাদের পরাজয়ের গ্লানির কথা।

লেখাটি শেষ হতে হতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোট গণনা শেষের দিকে। তবে এখনো বহু ভোট গোনার বাকি। কিন্তু তার পূর্বেই ট্রাম্প নির্বাচনে বিজয়ী হবার ঘোষণা দিয়েছেন। অধ্যাপক হজেসকে কি বলব। তিনি তো আশংকা প্রকাশ করেছিলেন এমন ফলাফল হলে তা হবে সবার সম্মিলিত পরাজয়! তাই কি ঘটতে যাচ্ছে। এক ‘অদ্ভুত আঁধার’ কি নেমে আসবে গোটা পৃথিবীর বুকে। কে জানে! বাংলাদেশেও হয়তো নেমে আসতে পারে এমন অন্ধকার। তেমন আঁধারে মুক্তিযুদ্ধের ঔজ্জ্বল্য নিয়ে গর্বিত ভঙ্গিমায় সবার সামনে সমুজ্বল থাকা মুক্তিযুদ্ধের অস্ত্রগুলো আমাদের সাহস জোগাবে।