কমিশনের প্রতিবেদনে গুমের লোমহর্ষক চিত্র

Published: 16 December 2024

পোস্ট ডেস্ক :

কারও মুখ সেলাই করে দেয়া হয়েছে। কানে এবং যৌনাঙ্গে দেয়া হয়েছে কারেন্টের শক। পালাতে গিয়ে নদীতে ঝাঁপ দিয়েও রক্ষা হয়নি। পাড়ে তুলে এনে হত্যা করা হয়েছে। এমনই লোমহষর্ক ঘটনা ঘটে গেছে গুমের শিকার ব্যক্তিদের জীবনে। সরকারের গঠিত গুম কমিশনে নিজেদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া গুমের ঘটনা ও নির্যাতনের গল্প বলেছেন ভুক্তভোগীরা। সেসব ঘটনার সংক্ষিপ্ত সারসংক্ষেপ শনিবার প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের হাতে প্রতিবেদন আকারে জমা দিয়েছে কমিশন। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, কীভাবে গুম করা হয়েছে। সরকারের শীর্ষ মহল থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা কীভাবে এসব মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ড সংঘটিত করেছেন। কোনো কোনো ঘটনায় পার্শ্ববর্তী দেশের সম্পৃক্ততা যে ছিল তার চিত্রও উঠে এসেছে গুম কমিশনের প্রতিবেদনে। ‘আনফোল্ডিং দ্য ট্রুথ’ শিরোনামে জমা দেয়া রিপোর্টে কমিশন সদস্যরা এখন পর্যন্ত পাওয়া এক হাজার ৬৭৬টি অভিযোগের মধ্যে ৭৫৮ জনের অভিযোগ যাচাই-বাছাই করেছেন। এতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার গুম করার পদ্ধতির কিছু বর্ণনা আছে। কমিশনের তদন্ত, ঘটনায় সম্পৃক্ত কর্মকর্তা ও নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিদের বয়ানে উঠে এসেছে গুম ও নির্যাতনের নানা রোমহর্ষক বর্ণনা। অভিযোগের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০১৬ সালে সর্বোচ্চ ১৩০টি গুমের ঘটনা ঘটেছে এবং ২০২৪ সালে এখন পর্যন্ত ২১টি অভিযোগ জমা পড়েছে। প্রতিটি অভিযোগের ভিত্তি হিসেবে- গুমের স্বাধীনতা হরণ, রাষ্ট্রীয় বাহিনী বা কর্তৃপক্ষের ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকা, ভিকটিমের অবস্থান সম্পর্কে তার পরিবার বা সমাজকে না জানানো এবং ভুক্তভোগীকে কোনো আইনি সুরক্ষা না দেয়ার মতো বৈশিষ্ট্যের কথা প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে কমিশন।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কাউকে গুম করার ক্ষেত্রে দুই ধরনের পদ্ধতি ব্যবহার করা হতো। অনেক সময় প্রথমে কাউকে আটক করে নির্যাতন করে অন্যদের নাম আদায় করা হতো। এরপর তাদেরও ধরে এনে নির্যাতন করা হতো। পরে এদের সবাইকে গুম করা হতো। এছাড়া রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তি বা নেতার সরাসরি নির্দেশেও গুম ও নির্যাতন হতো।

উদাহরণ হিসেবে নারায়ণগঞ্জের সাত খুন মামলার সময় তৎকালীন র‍্যাব কর্মকর্তা তারেক সাঈদ মোহাম্মদের স্বীকারোক্তির কথা তুলে ধরা হয়েছে। গুমের ক্ষেত্রে ভিকটিমদের অবস্থান চিহ্নিত করতে মোবাইল প্রযুক্তির সহায়তা নেয়া হতো বলে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। সাধারণত সাদা পোশাকে ভুক্তভোগীদের তুলে নেয়া হতো এবং নিজেদের পরিচয় গোপন করার জন্য এক সংস্থা আরেক সংস্থার নাম ব্যবহার করতো বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। উদাহরণস্বরূপ, পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) অভিযান চালিয়ে নিজেদের র‍্যাব বলে দাবি করতো বা র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব) নিজেদের ডিজিএফআই হিসেবে পরিচয় দিতো।
আটক করার পর ভুক্তভোগীদের সাধারণত গোপন অন্ধকার কক্ষে রাখা হতো এবং সেখানেই তাদের ওপর নানা ধরনের নির্যাতন চালানো হতো বলে অভিযোগ করেছে কমিশন। আটকের সময়কাল কখনো ৪৮ ঘণ্টা থেকে কয়েক সপ্তাহ, এমনকি কয়েক মাস পর্যন্ত হতো। এমন কয়েকজন ভুক্তভোগীর সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে কমিশন বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে এমন আটটি গোপন কারাগারের সন্ধান পাওয়ার কথা জানিয়েছে। যেগুলো ডিজিএফআই, র‍্যাব, কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) পরিচালনা করতো। কমিশন ইতিমধ্যে ঢাকা ও চট্টগ্রামের বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ অফিস পরিদর্শন করেছে, যার মধ্যে রয়েছে র‍্যাব ইউনিট, ডিবি সদর দপ্তর এবং অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অফিস। এসব আটককেন্দ্রের মধ্যে কাঠামোগত মিল পাওয়ার কথা জানিয়েছে কমিশন। এ ধরনের মিল থেকে কমিশন ধারণা করছে যে, পুরো বিষয়টি কোনো একটি কেন্দ্র থেকে পরিকল্পনা ও তদারকি করা হতো। কিছু নির্যাতনের ধরন ছিল অত্যন্ত ভয়াবহ, যেমন পেটানো, বৈদ্যুতিক শক দেয়া। সাধারণত র‍্যাব ও ডিজিএফআই-এর বিভিন্ন স্থাপনায় এসব নির্যাতনের সব বন্দোবস্ত ছিল বলে প্রতিবেদনে জানানো হয়। বিশেষ করে সেনাবাহিনীর পরিচালিত বন্দিশালাগুলোয় নির্যাতনের জন্য বিশেষ যন্ত্রপাতি ব্যবহৃত হতো, যার মধ্যে ছিল সাউন্ডপ্রুফ কক্ষ এবং শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের জন্য ডিজাইন করা বিভিন্ন যন্ত্র।

কমিশন দু’টি নির্যাতনের উদাহরণ দিয়েছে। ২০১০ সালে, ঢাকার ধানমণ্ডি থেকে র‍্যাব এক যুবককে অপহরণ করে কোনো অ্যানেসথেসিয়া ছাড়া ঠোঁট সেলাই করে দেয়। আরেক ভুক্তভোগীর ওপর নানা শারীরিক নির্যাতন চালানো হয়, বিশেষ করে তার কানে ও যৌনাঙ্গে বৈদ্যুতিক শক দেয়া হয়। গুমের শিকারদের বেশির ভাগ সময় হয় মেরে ফেলা হতো, নাহলে অপরাধী হিসেবে বিচার ব্যবস্থায় সোপর্দ করা হতো।

গুমের শিকার অনেকেই হত্যার শিকার হয়েছে বলে প্রমাণ পাওয়ার কথা জানিয়েছে গুম কমিশন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভিকটিমদের মাথায় গুলি করে মেরে ফেলা হতো এরপর মৃতদেহ সিমেন্টের ব্যাগের সঙ্গে বেঁধে নদীতে ফেলে দেয়া হতো যেন মৃতদেহ ডুবে যায়। যেসব নদীতে এসব লাশ গুম করা হতো, তার মধ্যে রয়েছে বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যা নদী। সেজন্য কাঞ্চন ব্রিজ ও পোস্তগোলা ব্রিজ ব্যবহার করা হতো। এক সাক্ষীর বরাতে কমিশন জানিয়েছেন, র‍্যাব’র একটি ‘ওরিয়েন্টেশন’ সেশনে তাকে দু’জন ভিকটিমকে গুলি করে হত্যার ঘটনা দেখানো হয়েছিল। এক সেনা সদস্য, যিনি র‍্যাব’র গোয়েন্দা শাখায় কর্মরত ছিলেন, তার বরাতে গুম কমিশন জানিয়েছে যে, এক ভুক্তভোগী নদীতে ঝাঁপ দিয়ে পালানোর চেষ্টা করেছিলেন। তাকে উদ্ধারের পর, সেখানেই গুলি করে হত্যা করা হয়। আরেকটি ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে, এক সেনা সদস্য জানান, তাকে একটি লাশ নিয়ে ঢাকার রেললাইনের ওপরে রেখে ট্রেনের অপেক্ষা করতে বলা হয় যেন ট্রেনের চাপায় লাশটি ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়।

একজন ভিকটিমের ফোন রেকর্ডের বরাতে প্রতিবেদনে জানানো হয়, তাকে প্রথমে ডিজিএফআই’র একটি সেলে রাখা হয়, এরপর ঢাকার র‍্যাব’র বিভিন্ন ডিটেনশন সেন্টারে নিয়ে যাওয়া হয়। শেষে তাকে চট্টগ্রামে র‍্যাব-৭ কর্তৃক গ্রেপ্তার দেখানো হয়। কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, এ সবকিছুর পেছনে একটাই উদ্দেশ্য ছিল ভিকটিমদের নির্মূল করা এবং লাশ এমনভাবে সরানো হয়- যেন সেগুলো পুনরুদ্ধার বা শনাক্ত করা না যায়। তবে যারা গুম হওয়ার পর ফিরে এসেছেন তাদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে আরও নানা তথ্য পাওয়ার কথা জানিয়েছে কমিশন। কমিশনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গুমের শিকারদের মধ্যে ৭৩% আবার জীবিত ফিরে এসেছেন, তবে ২৭% এখনো নিখোঁজ।

কমিশনের তদন্তে উঠে এসেছে যে, জোরপূর্বক গুমের বেশির ভাগ ক্ষেত্রে র‍্যাব, পুলিশের ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চ (ডিবি), এবং সিটিটিসি (কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম) ইউনিটগুলো প্রধান ভূমিকা পালন করেছে। অনেক ক্ষেত্রেই জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই) এবং ডিজিএফআই (ডিরেক্টরেট জেনারেল অব ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্স)-এর নামও উঠে এসেছে। দেশের এবং আন্তর্জাতিক আইনে এক্ষেত্রে শাস্তির বিধান থাকলেও অনেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা দেশের বাইরে পালিয়ে গিয়ে জবাবদিহি এড়ানোর চেষ্টা করেছেন বলে কমিশনের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। বাংলাদেশে গুমের ঘটনা শুধু অভ্যন্তরীণ সমস্যা নয়, বরং আন্তর্জাতিক চক্রান্তের অংশ- বিশেষ করে ভারতীয়দের জড়িত থাকার কথা কমিশনের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। সুখরঞ্জন বালি এবং বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদকে গুমের পর ভারতে স্থানান্তরের ঘটনা এখানে উদাহরণ হিসেবে বলা হয়েছে। এছাড়া বিএনপি’র জাতীয় স্থায়ী কমিটির প্রয়াত সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ছেলে হাম্মাম কাদের চৌধুরী তার বন্দিশালায় হিন্দি ভাষাভাষী লোকদের কথা শোনার কথা কমিশনকে জানিয়েছেন। তার দাবি- মুক্তির সময় তাকে বলা হয়েছিল: ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনাকে দ্বিতীয় সুযোগ দিচ্ছেন, তবে কিছু শর্ত রয়েছে। আপনাকে অবশ্যই রাজনীতি থেকে বিরত থাকতে হবে, দেশ ত্যাগ করতে হবে।’ অন্যদিকে সালাহউদ্দিন আহমেদকে ২০১৫ সালে ঢাকার উত্তরা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং পরবর্তীতে তাকে ভারতের হাতে তুলে দেয়া হয়। তার অভিজ্ঞতা থেকে জানা গেছে, তাকে যে নির্জন স্থানে রাখা হয়েছিল সেখানে টিএফআই (টাস্ক ফোর্স অব ইন্টারোগেশন) লেখা কম্বল ছিল, সেই সময়ে র‍্যাব সদর দপ্তরের তত্ত্বাবধানে টিএফআই পরিচালিত হতো। কমিশনের দাবি, র‍্যাব গোয়েন্দা শাখা যারা এ ধরনের অভিযানে সক্রিয় ছিল তারা জানিয়েছে যে, ভারত ও বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী বন্দিবিনিময় করতো।
গুম বিষয়ক কমিশনের প্রধান মইনুল ইসলাম চৌধুরী আগামী বছরের মার্চে আরও একটি অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন দেয়ার কথা জানিয়েছেন। চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিতে কমপক্ষে আরও এক বছর সময়ের প্রয়োজন বলে তিনি জানিয়েছেন।