দুর্গতির মধ্যেই এবার দেবী আবাহন
।। স্বপন কুমার সাহা ।।
মহামারি করোনায় বিপর্যস্ত গোটা পৃথিবী। বাংলাদেশও বিপর্যস্ত, প্রতিদিনই এই মহামারি প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে, আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। বিপর্যস্ত অর্থনীতি, মানুষ অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই করছে। জীবন-জীবিকার ওপর বিস্তৃত হয়েছে করোনার থাবা। আমরা এরই মধ্যে অনেক ঘনিষ্ঠজনকে হারিয়েছি। অসহায় হয়ে পড়েছে হাজার হাজার পরিবার। এরই মধ্যে এবার বাংলাদেশে শারদীয় দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
অনেকটা নিয়ম রক্ষার ধর্মীয় আয়োজন। সাধারণত দুর্গাপূজা বাঙালিজীবনে উৎসবের বার্তা নিয়ে আসে। এবার দেবী দুর্গার সত্যিকার দুর্গতিনাশিনীরূপেই মর্ত্যে আগমন ঘটেছে সন্তানের আকুল আহ্বানে সাড়া দিয়ে। দুর্গতি থেকে রক্ষার আকুতিই এবার অঞ্জলিতে ধ্বনিত হবে।
পূজার প্রস্তুতি অনেক আগেই শুরু হয়ে যায় বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় উৎসবের। কিন্তু এবার ব্যতিক্রম। পূজা হচ্ছে অনেক সীমাবদ্ধতায়, স্বাস্থ্যবিধি মেনে। পূজার সংখ্যা স্বাভাবিকভাবেই কমেছে। এবারের পূজা আনন্দ উৎসবের নয়, এবারে পূজা হবে মানবজাতিকে দুর্গতি থেকে উত্তরণের আকুল আহ্বানে।
দুর্গতিনাশিনী মা এবার আসছেন দোলায়, শাস্ত্রীয় নিয়মে মড়ক অবশ্যম্ভাবী। তার আলামত আমরা তো দেখতেই পাচ্ছি। করোনাসৃষ্ট ভয়াবহ মহামারির মধ্যেই মা আসছেন। তবে সুসংবাদও আছে, মা পূজার পরে যাবেন গজে, ফল শস্যপূর্ণ বসুন্ধরা। অন্ধকারের পরে সূর্যোদয়, দুর্যোগের পরে আলোর বন্যা। এতো প্রাকৃতিক নিয়ম। তার ব্যত্যয় হতে পারে না। না হলে সৃষ্টি থাকে না। এবারের দুর্গাপূজা তাই সমৃদ্ধির আগমনী বার্তাও ঘোষণা করছে। এটা শুধু বাংলাদেশ নয়, গোটা মানবজাতির জন্যই সমৃদ্ধি ও কল্যাণের বার্তা। দুর্গতি থেকে মানুষকে মুক্তি দিতেই দুর্গতিনাশিনীর মর্ত্যে আগমন। মায়ের আশীর্বাদে করোনাসৃষ্ট বিপর্যয় অবশ্যই পরাজিত হবে, কেটে যাবে দুঃসময়। মানুষ আবার নতুন সূর্যোদয়ের মুখোমুখি হবে। এটা স্বাভাবিক নিয়মেই। অন্ধকারের পরেই আলো আসে।
মহামারির মধ্যেই মাতৃ-আরাধনা। স্বাভাবিকভাবে পূজায় মহামারির প্রভাব পড়েছে। পাঁচ দিনের পূজা। এবারের ধারা ব্যতিক্রম। মহালয়ার এক মাসেরও বেশি সময় পর দুর্গাপূজা হচ্ছে। মলমাস পড়ার কারণেই এই ব্যতিক্রম। মহালয়ায় দেবীপক্ষের সূচনা হয়। এবারে বিরাজিত প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেই সন্তানরা মায়ের পূজার্চনা করবেন, অঞ্জলি দেবেন। প্রার্থনা জানাবেন শান্তি-সমৃদ্ধির, মহামারি থেকে মানবজাতির মুক্তির, অন্ধকার থেকে আলোয় উত্তরণের। বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের মানুষের জন্যই এই প্রার্থনা। বিপর্যয়ের পর নতুন জীবনের প্রার্থনা।
করোনার কারণে এবারের পূজায় উৎসবের দিকটি কাটছাঁট হয়েছে। স্বাভাবিকভাবে ভক্তসমাগম কম হতে পারে। পূজার দুটি দিক—একটি সামাজিক, অন্যটি ধর্মীয়। মায়ের পূজায় ভক্তরা অংশ নেবে, অঞ্জলি দেবে, হৃদয়ের আকুতি ব্যক্ত করবে মায়ের কাছে। মায়ের আরতি হবে। পরিবারের সবাই শরিক হবে পূজায়। মায়ের পূজায় হৃদয়ের দিকটি বড়। পাঁচ দিনব্যাপী পূজায় নানা আনুষ্ঠানিকতা, প্রতিটি অনুষ্ঠান গভীর অর্থবহ। ধর্ম ও সমাজের সঙ্গে সম্পর্কিত। তাই সবার অংশগ্রহণে পূজা হয় সর্বজনীন।
এখানে সামাজিক দিকটি নিয়ে আলোচনা প্রয়োজন। কারণ শারদীয় দুর্গাপূজা কার্যত একটি সামাজিক সম্মিলনী। বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের ১২ মাসে ১৩ পার্বণ, প্রতিটি পার্বণের সঙ্গে প্রকৃতি ও জীবনসম্পর্কিত, সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণ লক্ষণীয়। আরো লক্ষণীয়, ঋতুর সঙ্গে সম্পর্ক। দুর্গাপূজা শরৎকালে, যখন বর্ষাধৌত প্রকৃতি নতুন রূপ ধারণ করে। মাঠের ফসল ঘরে ওঠার অপেক্ষার ক্ষণগণনা শুরু হয়। বাঙালি রূপকল্পনায় এ সময় দেবী মর্ত্যে আসেন পরিবারের সব সদস্যকে নিয়ে, এই আগমনকে কন্যার বাপের বাড়ি আসার সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। দশমীর দিন যেভাবে মা বিদায় নেন, তাতে পিত্রালয় থেকে কন্যার বাপের বাড়ি ফিরে যাওয়ার চিত্রটিই ফুটে ওঠে। বাঙালি মানসিকতায় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিই প্রধান।
করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত হবে সামাজিক মেলবন্ধন, সহজ কথায় পূজার সামাজিক দিকটি। সেটাই পূজার উৎসব। শারদীয় দুর্গাপূজা মূলত বাঙালির উৎসব। প্রতিটি পরিবারে এই উৎসবকে কেন্দ্র করেই সবার সম্মিলন ঘটে। মা আসছেন, তাই পরিবারের সব সদস্য একত্র হওয়ার চেষ্টা করেন। আগে দেখা যেত শারদীয় দুর্গাপূজায় বাঙালি ঘরে ফেরত, সারা বছরের মধ্যে বিদেশে কর্মরতদের এটা পরিবারের সঙ্গে মিলিত হওয়ার একটা বড় উপলক্ষ। তৎকালীন সামাজিক অবস্থার বিবরণ থেকে জানা যায়, তখন পারিবারিক পূজা ছিল বেশি। সর্বজনীন বা বারোয়ারি পূজা ছিল কম। তবু পূজায় বাড়ি ফিরতেন সবাই। লক্ষ্মীপূজা পর্যন্ত অবস্থান করতেন, এর পরই কর্মস্থলে ফেরার পালা। তাই পূজাই ছিল কার্যত পারিবারিক উৎসব। বর্তমানে পূজা বেড়েছে। বলা যায় বাড়ির কাছেই পূজা। বেড়েছে সম্পৃক্ততা। সারা দেশে ৩২ হাজারেরও বেশি পূজা হয়েছে গত বছর। অনুকূল রাজনৈতিক পরিবেশের কারণে পূজা বেড়েছে প্রতিবছর। স্বাভাবিক অবস্থা থাকলে এ বছর পূজা আরো বাড়ত। কিন্তু এবার করোনার কারণে পূজা বাড়েনি। এক হাজারেরও বেশি পূজা এবার কম হচ্ছে। অবশ্যই এ অবস্থা সাময়িক, করোনাকাল কেটে যাবে, আবার উৎসব ফিরবে উৎসবের আঙ্গিকে। তবে সামাজিক সম্মিলনে যে ব্যাঘাত ঘটবে আমরা সেটা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সুস্থ ও সুন্দর ব্যবহারের মাধ্যমে কাটিয়ে উঠতে পারি কিছুটা। অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে, পূজার সৌন্দর্য ব্যাহত হওয়ার মতো কিংবা ধর্মীয় চেতনা ক্ষুণ্ন হতে পারে এমন কিছু যেন না হয়। যোগাযোগ বৃদ্ধিই উৎসবের ঘাটতি পূরণ করবে।
পূজার ধর্ম ও সামাজিক বন্ধন ছাড়াও আরেকটি দিক রয়েছে। পূজা মানসিক দৃঢ়তা ও একাগ্রতা বাড়ায়। মায়ের কাছে ভক্তপ্রাণ জ্ঞান, প্রজ্ঞা, শক্তি ও জয় প্রার্থনা করে। বলতে দ্বিধা নেই, করোনাকালে পূজা এই দৃঢ়তাকে আরো শক্ত ভিত্তি দেবে। লড়াই করার মানসিক শক্তি বাড়াবে। আমরা মায়ের কাছে শুধু নিজের জন্য প্রার্থনা করি না, সারা বিশ্বের কল্যাণ ও সমৃদ্ধির জন্যও প্রার্থনা জানাই। এবারের প্রার্থনা হোক করোনামুক্ত পৃথিবীর নতুন জীবনে অভিষেকের। করোনাও এক ভয়াবহ অসুর, এ অসুরও পরাস্ত হবে। মানুষ তো হারতে পারে না। এখানে অবশ্যই উল্লেখ করতে হয়, ঢাকেশ্বরী অঙ্গনে আমরাই প্রথম জন্মাষ্টমীর গীতাযজ্ঞে গোটা মানবজাতির কল্যাণে আহুতি দিই, প্রার্থনা করি। সব ধর্ম মিলেই মানবধর্ম, মানুষের কল্যাণেই বিশ্বের কল্যাণ। শারদীয় দুর্গাপূজায়ও এই ভাব বিস্তৃত হয়েছে। বিস্তৃত হয়েছে সারা দেশে পূজা কমিটিগুলোর মধ্যে। বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ এরই মধ্যে বাংলাদেশ তথা বিশ্বের মানুষের করোনা থেকে মুক্তির জন্য মা দুর্গার কাছে প্রার্থনা করার জন্য পূজা কমিটিগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে।
এবারে মাতৃ-আরাধনায় প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে আরেক বেদনার মুখোমুখি আমরা। আমাদের পথনির্দেশক বীর মুক্তিযোদ্ধা, অন্যতম সেক্টর কমান্ডার মেজর জেনারেল (অব.) সি আর দত্ত বীর-উত্তম আর আমাদের মধ্যে নেই। শেষ কিছুদিন তিনি আমেরিকায় প্রবাসজীবনে ছিলেন। সেখানেই গত ২৪ আগস্ট (বাংলাদেশের হিসাবে ২৫ আগস্ট) অনন্তধামে যাত্রা করেন। তিনি চোখের আড়ালে গেলেও আমাদের হৃদয়ে তিনি আলোকবর্তিকা।
আজ ঢাকেশ্বরী মন্দির জাতীয় মন্দিরে পরিণত। সারা দেশের হিন্দু সম্প্রদায়কে পূজার মাধ্যমে ঐক্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখাচ্ছে বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ ও মহানগর সর্বজনীন পূজা কমিটি। এই তাগিদ যিনি সৃষ্টি করেছিলেন তিনি আমাদের নেতা, শিক্ষক জেনারেল দত্ত। বিশ্বের ইতিহাসে কোনো ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে পূজা বা ধর্মচর্চার মধ্য দিয়ে অধিকার বোধের চেতনাকে জাগ্রত করার ধারা নজিরবিহীন। আমাদের নেতারা এই ধারা তৈরি করেছেন। বিশ্বের ইতিহাসে দেখা যায়, সংখ্যালঘুরা নিরাপত্তার কারণে একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপের অধিবাসী হয়ে থাকতে চায়, নিজস্ব সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য রক্ষায় ব্যাপৃত থাকে। কিন্তু বাংলাদেশ একমাত্র ব্যতিক্রম। এখানে সংখ্যালঘুরা মূল গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে কাজ করে। স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র রক্ষার জন্য লড়াই করে। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধিকারের লড়াই, গণ-অভ্যুত্থান থেকে মুক্তিযুদ্ধ—সংখ্যালঘুরা এক স্রোতোধারায় মিলিত হয়েছে, রক্ত মিশেছে সবার রক্তের সঙ্গে। সর্বজনীনতার ধারাটি এভাবে তৈরি হয়েছে। পরবর্তী সময়ে আমরা পূজার মাধ্যমে তা বিস্তৃত করার চেষ্টা করছি। ‘ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার’ কিংবা ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’ এই চেতনার মূল সুর ঢাকেশ্বরী অঙ্গন থেকেই উৎসারিত হয়েছিল, যা গোটা জাতি আজ গ্রহণ করেছে।
তাই করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধকেও আমরা ধর্মীয় অঙ্গনে সীমাবদ্ধ রেখে নয়, সর্বজনীন চেতনায় দেখতে চাই। দুর্গতিনাশিনীর কাছে আমরা সবার প্রার্থনাই নিবেদন করি। কারণ দুর্গতির বিরুদ্ধে লড়াই সর্বজনীন। সৃষ্টির আদিকাল থেকেই এই লড়াই চলে আসছে।