বাঙালি ও বাংলার কবি

Published: 25 May 2021

।।সেলিনা হোসেন।।


সংস্কৃতি এবং রাজনীতি জনজীবনের প্রবহমান ধারায় এক অসাধারণ বলয়। এই বলয় ছাড়া মানুষের জীবনচর্চা পরিশুদ্ধ হয় না। সংস্কৃতি জীবনকে পরস্ফুিটিত করে। রাজনীতি জীবনকে গতিময় করে। স্বৈরাচারী শাসন যেমন জনজীবনের কাম্য নয়, তেমনি অপরিশীলিত সংস্কৃতির চর্চা জনজীবনের কাম্য নয়। স্বৈরাচারী শাসন রুদ্ধ করে মানবিক অধিকারের খোলা প্রান্তর। অপরিশীলিত সংস্কৃতি ঘটায় মূল্যবোধের অবক্ষয়। সংস্কৃতি যেকোনো জাতির শিকড়ের গভীরতা। আত্মপরিচয়ের গভীরতম উৎস। সংস্কৃতির কবি কাজী নজরুল ইসলাম সাহিত্যের মাধ্যমে বাঙালির গৌরবকে সাহসের সঙ্গে একটি অসাধারণ পঙক্তি উচ্চারণ করেছিলেন, ‘বল বীর, বল উন্নত মম শির।’

১৯২২ সালে প্রকাশিত হয়েছিল ‘বিদ্রোহী’ কবিতা। দেশে তখন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন চলছে। ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্য মুক্তিপাগল মানুষ মরিয়া হয়ে উঠেছে। নজরুলই একমাত্র কবি, যিনি স্বাধীনতার পক্ষে লড়াকু সৈনিক হয়ে উঠেছিলেন। ব্রিটিশ সরকার তাঁকে জেলে ঢুকিয়েছিল। তিনি তাঁর ‘ধূমকেতুর পথ’ নিবন্ধে লিখেছিলেন, “সর্বপ্রথম ‘ধূমকেতু’ ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা চায়। স্বরাজ-টরাজ বুঝি না, কেননা ও কথাটার মানে এক এক মহারথী এক এক রকম করে থাকেন। ভারতবর্ষের এক পরমাণু অংশও বিদেশির অধীন থাকবে না। ভারতবর্ষের সম্পূর্ণ দায়িত্ব, সম্পূর্ণ স্বাধীনতা রক্ষা, শাসনভার সমস্ত থাকবে ভারতীয়দের হাতে। তাতে কোনো বিদেশির মোড়লি করবার অধিকারটুকু পর্যন্ত থাকবে না। যাঁরা এখন রাজা বা শাসক হয়ে এ দেশে মোড়লি করে দেশকে শ্মশানভূমিতে পরিণত করেছে, তাঁদের পাততাড়ি গুটিয়ে, বোঁচকা-পুঁটলি বেঁধে সাগরপারে পাড়ি দিতে হবে। প্রার্থনা বা আবেদন-নিবেদন করলে তাঁরা শুনবেন না। তাঁদের অতটুকু সুবুদ্ধি হয়নি এখনো। আমাদের এই প্রার্থনা করার, এই ভিক্ষা করার কুবুদ্ধিটুকুকে দূর করতে হবে। পূর্ণ স্বাধীনতা পেতে হলে সকলের আগে আমাদের বিদ্রোহ করতে হবে, সকল কিছু নিয়ম-কানুন, বাঁধন-শৃঙ্খল মানা নিষেধের বিরুদ্ধে।” শুধু কবিতা লিখে নয়, পত্রিকা প্রকাশ করেও অনবরত মানুষকে বিদ্রোহ করার পক্ষে উজ্জীবিত করেছেন কবি। তিনি ভারতবর্ষের এক পরমাণু অংশও বিদেশির হাতে থাকবে না বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন। চেয়েছিলেন পূর্ণ স্বাধীনতা।

এভাবেই তৈরি হয় সংস্কৃতি ও রাজনীতির বন্ধন। একজন সৃজনশীল মানুষ তাঁর সৃষ্টিকর্মের মাধ্যমে তাঁর গণমানুষ, সমাজ ও রাষ্ট্রের পরিস্থিতি নিজের প্রজ্ঞায় বিশ্লেষণ করেন। তা আপন সৃষ্টিকর্মের মাধ্যমে পৌঁছে দেন সমাজের সর্বস্তরের মানুষের কাছে। একজন রাজনীতিবিদও সৃজনশীল মানুষ, যখন তিনি গণমানুষের মর্যাদার বোধকে আলোয় নিয়ে আসেন। তাঁঁকে বুঝিয়েছেন কী তাঁর অধিকার, কোথায় তাঁর লড়াই।

এই রাষ্ট্রটি বিদ্রোহী কবির ভাষার রাষ্ট্র, যে ভাষায় তিনি তাঁর গণমানুষকে মাথা উন্নত রাখার ডাক দিয়েছিলেন। নজরুলই একমাত্র বাঙালি কবি, যিনি ভারতবর্ষের এক ইঞ্চি ভূমিও পরাধীন দেখতে চাননি। এ জন্য ঔপনিবেশিক সরকারের জেল-জুলুমের শিকার হয়েছিলেন। ধর্মঘট পালন করেছিলেন, তাঁকে জেলে অনশন ভাঙার ডাক দিয়ে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন, Our literature claims you. রবীন্দ্রনাথ তাঁকে অনশন ভাঙার আহ্বান জানিয়েছিলেন। তাঁর সৃজনশীল শক্তিকে অভিনন্দন জানিয়ে নিজের লেখা বই উৎসর্গ করেছিলেন। বিশ্বকবি একজন স্বাধীনতার পক্ষে লড়াকু কবিকে নন্দিত করেছিলেন এভাবে। আর বঙ্গবন্ধুই সেই রাষ্ট্রনায়ক, যিনি কালজয়ী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে স্বাধীন বাংলাদেশে এনে তাঁর বেঁচে থাকার বাকি দিনগুলো স্বস্তির করেছিলেন শারীরিকভাবে এবং মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে এই কবির গান অনুপ্রেরণার অন্তহীন উৎস ছিল।

পূর্ববঙ্গে ঘুরে বেড়ানোর সময় নজরুল এই ভূখণ্ডকে বারবার নমস্য মেনেছেন। ‘পূর্ববঙ্গ’ নামের কবিতায় এবং ‘বাংলাদেশ’ শীর্ষক গানে আবেগের মাত্রা প্রকাশ পায়। অসুস্থ হওয়ার কয়েক মাস আগে দৈনিক ‘নবযুগ’ পত্রিকায় একটি সম্পাদকীয় লিখেছিলেন ‘আমার সুন্দর’ নামে। এখান থেকে উদ্ধৃতি ‘আট বৎসর ধরে বাংলাদেশের প্রায় প্রতি জেলায়, প্রতি মহকুমায়, ছোট বড় গ্রামে ভ্রমণ করে দেশের স্বাধীনতার জন্য গান গেয়ে, কখনো কখনো বক্তৃতা দিয়ে বেড়ালাম। এই প্রথম আমার মাতৃভূমি বাংলাদেশকে ভালোবাসলাম। মনে হলো, এই আমার মা।’

১৯৪২ সালের এপ্রিল মাসে লিখলেন ‘বাঙালির বাঙলা’ নামের প্রবন্ধ। লিখলেন : ‘বাঙালিকে, বাঙালির ছেলেমেয়েকে ছোটবেলা থেকে শুধু এক মন্ত্র শেখাও, এই পবিত্র বাংলাদেশ বাঙালির, আমাদের। … বাঙলা বাঙালির হোক! বাঙলার জয় হোক! বাঙালির জয় হোক!’

লেখক : কথাসাহিত্যিক