এমন দিন দেখলে খুশি হতেন বঙ্গবন্ধু

Published: 30 May 2021

।। আবদুল মান্নান ।।

ফিরে যেতে হয় একাত্তরের যুদ্ধ শেষের দিনগুলোতে, যখন দেশের বেশির ভাগ মানুষের বাড়িতে খয়রাতি চাল না এলে চুলার আগুন জ্বলত না। চারদিকে বারুদের আর পচা লাশের গন্ধ। একদল বিদেশি সাংবাদিক পুরনো গণভবন চত্বরে বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্ন করলেন, আপনার দেশ তো সম্পূর্ণ ধ্বংসপ্রাপ্ত, দেশের দুটি সম্পূর্ণ বন্দর অচল, একমাত্র বিমানবন্দর তেজগাঁও সীমিত আকারে চালু আছে, গুদামে এক ছটাক চালও নেই, ব্যাংকে নেই কোনো বৈদেশিক অর্থ, পাকিস্তান সেনাবাহিনী সব খালি করে দিয়েছে, ‘আপনি এই দেশকে কিভাবে আবার দাঁড় করাবেন।’ বঙ্গবন্ধু তাঁর পাইপে একটা টান দিয়ে বললেন, ‘আমার দেশের মাটি আর মানুষ আছে। তাদের ওপর ভর kalerkanthoকরেই আবার এই দেশ উঠে দাঁড়াবে।’ আজীবন বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্ত অস্ত্র আত্মবিশ্বাস। তাঁর সেই প্রত্যাশিত বাংলাদেশ তিনি দেখে যেতে পারেননি। কিন্তু আজ তাঁর সেই স্বপ্নের বাংলাদেশ তাঁরই কন্যা শেখ হাসিনার হাত ধরে সম্মানের জায়গায় পৌঁছেছে। যে দেশে বৈদেশিক মুদ্রা বলতে কিছুই ছিল না, সেই বাংলাদেশ বন্ধুপ্রতিম দেশ শ্রীলঙ্কাকে ২০ কোটি ডলার (২০০ মিলিয়ন ডলার) ঋণ দিতে রাজি হয়েছে। এই ব্যতিক্রমধর্মী খবরটা যখন প্রকাশিত হলো তখন সারা বিশ্ব কভিড-১৯ অতিমারিতে সম্পূর্ণ পরাস্ত। বিশ্বের ২৩টি দেশ ছাড়া অন্য সব দেশের বার্ষিক গড় প্রবৃদ্ধির হার মাইনাসে। যে ২৩টি দেশের গড় প্রবৃদ্ধি প্লাসে আছে তার মধ্যে বাংলাদেশ বিশ্বে তৃতীয় এবং দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম। সবচেয়ে নাজুক অবস্থায় আছে ভারত, তারপর পাকিস্তান। ভারতের সার্বিক অবস্থা এতই খারাপ যে লেখক অরুন্ধতী রায় লিখেছেন, ‘আমাদের একটি সরকার দরকার।’ তাঁর মতে, ভারতের বর্তমান সরকার এই অতিমারি মোকাবেলায় সম্পূর্ণ ব্যর্থ। এসবের মধ্যে শ্রীলঙ্কাকে বাংলাদেশের এই ২০ কোটি ডলার ঋণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হলো।

অতিমারির কারণে দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি বেশ নাজুক অবস্থায়। তাদের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম খাত পর্যটনশিল্প প্রায় এক বছরের ওপর বন্ধ। সেবা খাতগুলোর অবস্থাও একই রকম। চা রপ্তানিতেও ভাটা পড়েছে। দুই দশক ধরে তামিল টাইগারদের সঙ্গে চলা দেশটিতে গৃহযুদ্ধের কারণে যে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে, সেখান থেকে এখনো পুরোপুরি উঠে দাঁড়াতে পারেনি। এই মুহূর্তে শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ মাত্র চার বিলিয়ন ডলার, যা তাদের দেশের আগামী তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটাতে পারবে। শ্রীলঙ্কা একটি আমদানিনির্ভর দেশ। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বর্তমানে ৪৫ বিলিয়ন ডলার। এই অর্থ দিয়ে বাংলাদেশ আগামী এক বছর তাদের আমদানি ব্যয় মেটাতে সক্ষম। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও বিদেশ থেকে রেমিট্যান্স আসার গতি চালু থাকলে আগামী দুই বছরে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৭০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাতে পারে। একটি দেশ যদি সময়মতো তাদের আমদানি ব্যয় মেটাতে সক্ষম না হয়, তাহলে একসময় সেই দেশটির এলসি (লেটার অব ক্রেডিট) অন্য দেশ গ্রহণ করে না, নিজ দেশের মুদ্রার মান নেমে যায় এবং কোনো একসময় দেশটি দেউলিয়া ঘোষিত হয়। সম্প্রতি বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে অংশগ্রহণ করতে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট রাজাপক্ষে ঢাকা এসেছিলেন। তিনি তখন একান্তে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ঋণ নেওয়ার কথাটি বলেছিলেন। শেখ হাসিনা ইতিবাচক জবাব দিয়ে জানিয়েছিলেন, তিনি অর্থমন্ত্রী আর বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত জানাবেন। কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই বাংলাদেশ সরকার শ্রীলঙ্কাকে জানিয়ে দিয়েছে তারা ৫০০ মিলিয়ন ডলার পর্যন্ত শ্রীলঙ্কাকে ২ শতাংশ সুদে ধার দিতে প্রস্তুত। এই সুদের হার আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রচলিত সুদের তুলনায় সামান্য বেশি হলেও যৌক্তিক কারণটি হচ্ছে, ধার দেওয়াটা বাংলাদেশের জন্য একটি বিনিয়োগ আর ঝুঁকি ছাড়া কোনো বিনিয়োগ হয় না। শ্রীলঙ্কা এরই মধ্যে বিশ্বব্যাংক, চীন আর ভারত থেকে এ ধরনের ঋণ নিয়েছে। সময়মতো এসব ঋণ পরিশোধ করতে না পারলে পরবর্তীকালে শ্রীলঙ্কার ধার নেওয়ার উৎস সংকুচিত হয়ে পড়বে। আর তখন শ্রীলঙ্কা চরম বেকায়দায় পড়তে পারে। বাংলাদেশ এই ধার মঞ্জুর করার ফলে আন্তর্জাতি মুদ্রাব্যবস্থায় বাংলাদেশের রেটিং ও সম্মান কয়েক গুণ বৃদ্ধি পাবে। শ্রীলঙ্কা এই ধার নেওয়ার জামানত হিসেবে ২০০ মিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণের শ্রীলঙ্কার মুদ্রা বাংলাদেশে জামানত রাখবে। তবে বাংলাদেশ যখন এই অর্থ ফেরত পাবে তখন ডলারের মূল্য যদি কমে যায় তাতে বাংলাদেশের একটা ঝুঁকি থেকেই যায়। বাংলাদেশ যে সুদের হারে শ্রীলঙ্কাকে ধারটি দিচ্ছে তা এই ঝুঁকি মোকাবেলায় যথেষ্ট হওয়ার কথা। অন্য দেশকে ধার দেওয়ার অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের এই প্রথম, তবে হয়তো শেষ নয়। বাংলাদেশে ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ার একাধিক দেশকে প্রয়োজনের সময় নানাভাবে সহায়তা করতে এগিয়ে এসে এই অঞ্চলে একটি ইতিবাচক উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। এর আগে দুটি দেশকে এক লাখ টন করে চাল উপহার দিয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে এই দেশগুলোর ফসল নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। সম্প্রতি ভারতের কভিড-১৯ মোকাবেলায় ওষুধ ও অন্যান্য চিকিৎসা সরঞ্জাম উপহার হিসেবে পাঠিয়েছে বাংলাদেশ, যার বেশির ভাগই যাবে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে।

শ্রীলঙ্কার সঙ্গে এসব লেনদেনের হিসাব যখন বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার মিডিয়ায় বেশ গুরুত্বের সঙ্গে প্রচারিত হচ্ছিল, ঠিক তখনই পাকিস্তান বংশোদ্ভূত অর্থনীতিবিদ ও বিশ্বব্যাংকের সাবেক অর্থনৈতিক উপদেষ্টা আবিদ হাসান পাকিস্তান থেকে প্রকাশিত ডেইলি নিউজ ইন্টারন্যাশনালে প্রকাশিত প্রবন্ধে বলেছেন, ‘পাকিস্তানের বর্তমান সরকারসহ প্রত্যেকটি সরকার প্রায়শ ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে বিভিন্ন দেশের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়ায়। আমরা ঋণে ডুবে যাচ্ছি এবং আমাদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন রক্তশূন্যতায় ভুগছে। কুড়ি বছর আগে এটি আমাদের ধারণারও বাইরে ছিল যে বাংলাদেশের গড় প্রবৃদ্ধি ২০২০ সালে এসে আমাদের প্রায় দ্বিগুণ হবে। ২০৩০ সাল নাগাদ বাংলাদেশ একটি অর্থনৈতিক পরাশক্তি হয়ে যেতে পারে, যদি তারা তাদের প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে পারে। পাকিস্তান যদি তার এই হতাশাব্যঞ্জক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে আটকে থাকে, তাহলে হয়তো ২০৩০ সালে পকিস্তান বাংলাদেশর কাছেও অর্থনৈতিক সাহায্য চাইতে পারে।’ আবিদ হাসান ২০২০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের বিশ্বব্যাংক কার্যালয়ে কর্মরত ছিলেন এবং তিনি বর্তমান সরকারের অর্থনৈতিক অগ্রগতির একজন সাক্ষী।

পাঠকদের মনে থাকতে পারে, ইমরান খানের দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ ২০১৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে বিজয় লাভ করে। ইমরান খান একজন বিশ্বনন্দিত ক্রিকেট খেলোয়াড় ছিলেন। দেশটির নবনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁর মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ উন্নয়ন পরিকল্পনা তুলে ধরে বলেন, তিনি পাকিস্তানকে সুইডিশ মডেলে উন্নয়নের সড়কে উঠাতে চান। সেই রাতে পাকিস্তানের বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে ইমরান খানের এই কথার পরিপ্রেক্ষিতে অর্থনীতিবিদরা বলেন, ‘সুইডেন নয়, পাকিস্তানকে প্রথমে বাংলাদেশ বানান।’ তাঁরা আরো বলেন, উন্নয়ন কিভাবে করতে হয় তা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বকে দেখিয়ে দিয়েছেন। আবিদ হাসান তাঁর প্রবন্ধে আরো লিখেছেন, ‘বাংলদেশ সঞ্চয়কে ভোগের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। তাদের সঞ্চয়ের পরিমাণ জিডিপির ৩০ শতাংশ। অন্যদিকে পাকিস্তানে এই সংখ্যা ১৫ থেকে ২০ শতাংশ। পাকিস্তানের মানুষের অপ্রয়োজনীয় ভোগের প্রতি ঝোঁক বেশি। ২০০০ সালে পাকিস্তানের রপ্তানি আয় বাংলাদেশের চেয়ে ৫০ শতাংশ বেশি ছিল। বাংলাদেশের বর্তমান রপ্তানি আয় পাকিস্তানের তুলনায় সাত গুণ বেশি (৭০০ শতাংশ)। পাকিস্তানের বর্তমান বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ১৩.৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আর বাংলাদেশের ৪৫ বিলিয়ন। আবিদ হাসান আরো বলেন, ‘শেখ হাসিনার নেতৃত্ব ছাড়াও বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে ধর্ম থেকে পৃথক করতে পেরেছে, অনির্বাচিত প্রতিষ্ঠান ও রাজনীতিবিদদের রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রমে হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে পেরেছে এবং দেশটির উন্নয়ন বাংলাদেশকেন্দ্রিক থেকেছে। এসব আমাদের জাতীয় অহংবোধে আঘাত করতে পারে; কিন্তু বাংলাদেশ থেকে সাহায্য সহায়তা চাইতে না হলে বাংলাদেশের মডেল অনুসরণ করতে হবে।’

বাংলাদেশ অনেক বেশি দূর এগিয়ে যেতে পারত যদি দেশটির এক শ্রেণির সরকারি পর্যায়ের কর্মকর্তার লাগামহীন দুর্নীতিতে লাগাম টেনে ধরা যেত। অতিমাত্রায় আমলানির্ভর প্রশাসনও দেশটির অগ্রযাত্রার পথে বড় অন্তরায়। অনেক ক্ষেত্রে সঠিক ও যোগ্য মানুষকে সঠিক স্থানে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। এসবের দিকে নজর দিলে বাংলাদেশ গত ৫০ বছরে যতটুকু এগিয়েছে, আগামী ৫০ বছরে তার চেয়ে অনেক বেশি অগ্রসর হতে বাধ্য। তবে বিগত ৫০ বছরে জিয়া আর এরশাদের সেনাশাসন দেশের অগ্রযাত্রা থামিয়ে দিয়েছিল। খালেদা জিয়া দেশের মানুষকে চরমভাবে হতাশ করেছেন। দুঃখের বিষয়, বাংলাদেশের এই সময় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের মাঝে নেই। সান্ত্বনা তাঁর কন্যার হাতে এখন বাংলাদেশ।

লেখক : বিশ্লেষক ও গবেষক