বড়লেখার বোবারথলের বাসিন্দাদের বছর জুড়েই সুপেয় পানির তীব্র সংকট

Published: 18 July 2021

আব্দুর রব, বড়লেখা :

মৌলভীবাজারের বড়লেখার ভারত সীমান্তসংলগ্ন একটি এলাকার নাম বোবারথল। বড়লেখা পৌর শহর থেকে এলাকাটির দূরত্ব প্রায় ১৫ কিলোমিটার। সবুজ অরণ্যে ঘেরা দুর্গম পাহাড়ি এই এলাকায় বাঙালি ও আদিবাসি খাসি সম্প্রদায়সহ প্রায় ১০ হাজার মানুষের বসবাস। প্রান্তিক জনপদের এসব মানুষ যুগ যুগ ধরে সুপেয় পানির জন্য দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। স্থায়ী কোনো ব্যবস্থা না থাকায় তারা বিভিন্ন পদ্ধতিতে পাহাড়ি ঝর্ণা অথবা পাহাড় চুঁইয়ে পড়া পানি সংরক্ষণ করে খাবারসহ দৈনন্দিন কাজে ব্যবহার করছেন। পানির জন্য তীব্র কষ্ট করলেও তা সমাধানে নেই কার্যকর কোনো উদ্যোগ।

জানা গেছে, উপজেলার দক্ষিণ শাহবাজপুর ইউনিয়নের পাহাড়ঘেঁষা ৬ নম্বর ওয়ার্ডটি বোবারথল নামে সর্বত্র পরিচত। এই নামে পরিচত হলেও বোবারথলসহ এখানে রয়েছে ১২টি গ্রাম। গ্রামগুলো হচ্ছে- বোবারথল, দক্ষিণ গান্ধাই, মাঝ গান্ধাই, পেকু ছাড়া, ইসলামনগর, শান্তিনগর, গান্ধাই পুঞ্জি, কুসবা নগর, বারোঘরি, ষাইটঘরি, করইছড়া, উত্তর করই ছড়া। আনুমানিক ১৯৬৫ থেকে ৬৬ সালের দিকে ওই এলাকায় মানুষের বসতি শুরু হয়। বর্তমানে জনসংখ্যা প্রায় ১০ হাজার। এখানে ১টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ৩টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ২টি মাদ্রাসা ছাড়াও আছে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। দুর্গম পাহাড়ি ওই গ্রামের বাসিন্দারা সুপেয় পানির জন্য কষ্টে দিন কাটান। যুগ যুগ ধরে তাদের এই কষ্ট চলছে। বর্ষায় মোটামুটি পানি পাওয়া গেলেও শুষ্ক মৌসুমে (প্রায় ৫ মাস) ভোগান্তি বেড়ে যায়। এসময় পানির বেশিরভাগ উৎস শুকিয়ে যায়। পানীয় জল, ধোয়ামোছাসহ নিত্যকাজের পানির আকাল থাকে বর্ষার আগ পর্যন্ত। তখন কয়েক কিলোমিটার দূরে গিয়ে প্রাকৃতিক কোনো উৎস থেকে তাদের পানি সংগ্রহ করতে হয়। অন্য সময় রিং কুয়া, ঝর্ণা ও পাহাড় চুঁইয়ে পড়া পানিই তাদের ভরসা। এসব উৎস থেকে বিভিন্ন পদ্ধতিতে তারা পানি ছেঁকে সংগ্রহ করেন।

দক্ষিণ গান্ধাই গ্রামের রইছ আলী বলেন, ‘আমরা এমনিতেই দুর্গম এলাকায় থাকি। যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই খারাপ। এরমধ্যে সবচেয়ে বড় কষ্ট পানির। বর্ষাকালে মোটামুটি পানি পাওয়া যায়। কিন্তু শুকনো মৌসুমে কষ্ট বেশি শুরু অয়। তখন বিভিন্ন জাগায় দৌঁড়ানি (দৌঁড়াতে) লাগে পানি সংগ্রহের জন্য। ভালা পানি (বিশুদ্ধ পানি) তো পাওয়া যায় না। ময়লাযুক্ত পানি মিলে। ছাঁকিয়া (ছেঁকে), ফুটাইয়া খাওয়া লাগে। ইতা পানি খাইয়া (এই পানি খেয়ে) রোগ হচ্ছে মানুষের।’


আরেক বাসিন্দা ফরিজ উদ্দিন বলেন, ‘সরকার আমরার পাড়ি (পাহাড়ি) এলাকাত বিদ্যুৎ দিছন (দিয়েছেন)। হুনছি রাস্তাও অনব (শোনেছি রাস্তা হবে)। কিন্তু সবতার আগে আমাদের পানির কষ্ট দূর হওয়া দরকার। খাবার পানি সংগ্রহ করা খুব কষ্ট অয় আমাদের।’ সোহাগ দর্জি বলেন, ‘সারা বছরই সুপেয় পানির সংকট থাকে। তবে শীত মৌসুমে পানি সংকটে এলাকায় হাহাকার শুরু হয়। এই এলাকার পানির উৎস বলতে পাহাড়ের নিচে ছোট ছোট কুয়া, ঝরনা। শুষ্ক মৌসুম এলেই ঝরনাগুলো শুকিয়ে যায়। বর্ষার সময় পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা করা হলেও শুষ্ক মৌসুম দেখা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় পানির ভোগান্তি।’

 

দক্ষিণ শাহবাজপুর ইউপি চেয়ারম্যান সাহাব উদ্দিন বলেন, ‘এলাকাটি খুব দুর্গম। নিচে পাথর থাকায় নলকূপ স্থাপন করা যায় না। রিং টিউবওয়েল (পাতকুয়া) করলেও পানি পাওয়া যায় না। ওই অবস্থায় মানুষ খুব কষ্ট করছে। কয়েকটি দপ্তর থেকে রিং কুয়া দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু শুকনো মৌসুমে এগুলোতে পানি পাওয়া যায় না। বছরের প্রায় ৫ মাস পানির জন্য মানুষকে বেশি কষ্ট করতে হয়। অন্যসময় পানি মিললেও এগুলো বিশুদ্ধ নয়। এতে পানিবাহিত রোগে অনেকে আক্রান্ত হন। দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার মাধ্যমে বিকল্প ব্যবস্থায় খাবার পানির ব্যবস্থা করলে তারা উপকৃত হবেন।’

উপজেলা উপ-সহকারী প্রকৌশলী (জনস্বাস্থ্য) মঈন উদ্দিন জানান, ‘বোবারথল এলাকাটি পাহাড়ি হওয়ায় মাটির ৫০-১০০ ফুট নিচে পাথরের স্তর পাওয়া যায়। সে কারণে ডিপ টিউবওয়েল স্থাপন করা যাচ্ছে না। দূরবর্তী কোনো এলাকা থেকে উৎপাদক নলকূপ স্থাপন করে পাইপ লাইনের মাধ্যমে সুপেয়ে পানি পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হবে। সে লক্ষ্যে স্থানীয় সংসদ সদস্য ও পরিবেশমন্ত্রী এবং নির্বাহী প্রকৌশলীর নির্দেশনায় বোবারথলসহ বিভিন্ন পাহাড়ি অঞ্চলে পাইপ লাইন স্কীমের মাধ্যমে পানি সরবরাহের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।’