বর্ণবাদী দক্ষিণ আফ্রিকায় শৈশব যেভাবে কেটেছিল ইলন মাস্কের
পোস্ট ডেস্ক :
লাল ইটের তৈরি প্রিটোরিয়া বয়েজ হাই স্কুলের মনোরম ভবনটি ১৯০১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি ছিল দক্ষিণ আফ্রিকার অন্যতম ইংরেজি বেসরকারি বিদ্যালয়। ইলন মাস্ক যিনি এখন মার্কিন রাজনীতির অন্যতম শক্তিশালী ব্যক্তি হয়ে উঠেছেন, তিনি ১৯৮০-এর দশকে দক্ষিণ আফ্রিকার এই স্কুলে সবুজ, গাছপালা ভরা ক্যাম্পাসে একজন ছাত্র হিসেবে তার স্কুল জীবন কাটিয়েছিলেন। স্কুলের কাছেই ওয়াটারক্লুফে তার বাবার বিশাল বাড়িটি ছিল বেগুনি জ্যাকারান্ডা ফুলের ছায়ায় আবৃত। বর্ণবাদ প্রবেশ করার সাথে সাথে দক্ষিণ আফ্রিকায় মাথাচাড়া দেয় প্রবল বিদ্রোহ। ১৯৮৪ সালে দেশজুড়ে কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে ওঠে। ১৯৮৬ সালের মধ্যে শ্বেতাঙ্গ সংখ্যালঘু সরকার জরুরি অবস্থা জারি করে। কিন্তু বিচ্ছিন্ন শ্বেতাঙ্গ ছিটমহলগুলিতে জীবন ছিল সমৃদ্ধ এবং শান্তিপূর্ণ। প্রিটোরিয়া বয়েজ-এ মাস্কের চেয়ে এক বছরের সিনিয়র জোনাথন স্টুয়ার্ট বলছেন, ‘যদিও পুরো দেশটিতে আগুন জ্বলছিল এবং অস্থিরতা বিরাজ করছিলো, আমরা আমাদের ছোট শহরতলিতে খুব নিরাপদে ছিলাম। স্বাভাবিক জীবনযাপন করছিলাম।’
প্রিটোরিয়া বয়েজ হাই স্কুলেই শৈশব কেটেছে লেবার রাজনীতিবিদ পিটার হেইন, বুকার পুরস্কার বিজয়ী ঔপন্যাসিক ড্যামন গ্যালগুট এবং প্যারালিম্পিয়ান অস্কার পিস্টোরিয়াসের মতো ব্যক্তিত্বদের।
১৯৭১ সালে প্রিটোরিয়ায় জন্মগ্রহণকারী মাস্ক গত মাসে তার সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম এক্স-এ তার জন্মস্থান দক্ষিণ আফ্রিকার ‘বর্ণবাদী আইনের’ বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিলেন। ‘শ্বেতাঙ্গ দক্ষিণ আফ্রিকানরা তাদের নিজ দেশে তাদের বর্ণের জন্য নির্যাতিত হচ্ছে’ এই বিবৃতিতে সম্মতি জানিয়েছিলেন মাস্ক। যিনি এখন ডনাল্ড ট্রাম্পের ‘সরকারি দক্ষতা বিভাগ(ডজ)’ -এর প্রধানের পদে আসীন।
শ্বেতাঙ্গ দক্ষিণ আফ্রিকানরা বেআইনি জমি বাজেয়াপ্তর লক্ষ্যবস্তু হচ্ছে। অন্যায়ভাবে জাতিগত বৈষম্যর শিকার হচ্ছে। সম্প্রতি এই অভিযোগ তুলে একটি নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করেছেন ট্রাম্প। এই আদেশে দক্ষিণ আফ্রিকার জন্য তহবিল বন্ধ করার কথা বলা আছে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে দক্ষিণ আফ্রিকা তার এইচআইভি/এইডস বাজেটের ১৭% পায়। ১৯৮৯ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা ছেড়ে তার মাতৃভূমি কানাডায় চলে যান মাস্ক। তারপর পাড়ি দেন যুক্তরাষ্ট্রে। ট্রাম্পকে এই আদেশ জারি করতে উৎসাহিত করার ক্ষেত্রে মাস্কের সরাসরি ভূমিকা কতটা ছিল তা স্পষ্ট নয় ।
ট্রাম্প তার প্রেসিডেন্ট পদের প্রথম মেয়াদ থেকেই শ্বেতাঙ্গ দক্ষিণ আফ্রিকানদের উপর কথিত নির্যাতনের বিষয়ে আগ্রহী। আফ্রিকানদের একটি অধিকার গোষ্ঠী যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে মিথ্যা দাবি করে যে সরকারের সহযোগিতায় শ্বেতাঙ্গ কৃষকদের তাদের জমির জন্য হত্যা করা হচ্ছে। ট্রাম্প ফক্স নিউজে গ্রুপের একজন নেতার সাক্ষাৎকার দেখে তার সমর্থনে টুইট করেন। ট্রাম্প অন্যান্য স্বার্থ দ্বারাও প্রভাবিত হয়েছেন, যার মধ্যে রয়েছে গাজা যুদ্ধের বিষয়ে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) ইসরাইলের বিরুদ্ধে দক্ষিণ আফ্রিকার মামলার সমালোচনাকারী মার্কিন দলগুলি। বিষয়টি তিনি তার নির্বাহী আদেশে উল্লেখ করেছেন। মাস্ক এখন ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টাদের মধ্যে রয়েছেন, তাই এটা ধরে নেয়া যেতে পারে যে তিনি তার মতামত প্রেসিডেন্টের কাছে প্রকাশ করেছেন। কারণ বিষয়টি দক্ষিণ আফ্রিকায় তার ব্যবসায়িক স্বার্থের সাথেও জড়িত।
মাস্ক দাবি করেছেন যে, দক্ষিণ আফ্রিকার জনসংখ্যার মাত্র ৭% শ্বেতাঙ্গ সংখ্যালঘু, যারা এখনও ৭০% এরও বেশি কৃষি জমির মালিক। তাই সেখানে ভূমি সংস্কার আইন বর্ণবাদী মনোভাবের প্রকাশ এবং চুরির শামিল। তিনি দাবি করেছেন যে, শ্বেতাঙ্গ কৃষকরা গণহত্যার শিকার; গবেষণায় দেখা গেছে যে অপরাধগুলি আর্থিকভাবে প্ররোচনা দেয়া হয়েছে। মাস্কের আক্রমণ এমন এক সময়ে তীব্র আকার ধারণ করেছে যখন তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার সরকারের সাথে আইনি বিবাদে লিপ্ত। কারণ তিনি সেদেশে তার স্টারলিংক স্যাটেলাইট নেটওয়ার্ক বিক্রি করার চেষ্টা করছেন। বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিটি এমন একটি আইনের বিরোধিতা করছেন যেখানে টেলিকম সেক্টরের বিদেশি বিনিয়োগকারীদের দক্ষিণ আফ্রিকার অংশের ৩০% ইকুইটি কৃষ্ণাঙ্গ মালিকানাধীন ব্যবসাগুলিকে প্রদান করতে হবে।
ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশ দক্ষিণ আফ্রিকার সরকারের উপর চাপ বৃদ্ধি করবে যাতে মাস্ককে কৃষ্ণাঙ্গ ক্ষমতায়ন আইন থেকে অব্যাহতি দেওয়া যায়। এক্স-এর প্রেস টিম এবং মাস্কের আইনজীবী এ সংক্রান্ত প্রশ্নের কোনও উত্তর দেননি। গত মাসে ট্রাম্পের অভিষেক অনুষ্ঠানে নাৎসি স্যালুটের মতো অঙ্গভঙ্গি দেখানো থেকে শুরু করে জার্মানির অল্টারনেটিভ ফার ডয়চল্যান্ডের মতো অতি-ডানপন্থী রাজনৈতিক দলগুলিকে আলিঙ্গন করা-বর্ণবাদী শাসনের আবহে মাস্কের বেড়ে ওঠার বছরগুলি আজকে তার এই অবস্থানের জন্য কতটা দায়ী এগুলো তারই প্রমাণ। মাস্কের পরিবারের মতো শ্বেতাঙ্গ, ইংরেজিভাষী দক্ষিণ আফ্রিকানরা বর্ণবাদের শ্রেণিবিন্যাস থেকে উপকৃত হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা শাসক আফ্রিকানদের থেকে আলাদা জীবনযাপন করত।
দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রথম দুই বছর মাস্ক জোহানেসবার্গের উত্তরাঞ্চলীয় শহরতলিতে অবস্থিত সাদা ব্রায়ানস্টন উচ্চ বিদ্যালয়ে কাটিয়েছেন। ১৯৬৮ সালে প্রতিষ্ঠিত, এটি একটি ইংরেজি-ভাষার রাষ্ট্রীয় বিদ্যালয়। ব্রায়ানস্টন হাই স্কুলেও খেলাধুলার চল ছিল। অনেকটা সেইসময়ের আমেরিকান সমাজের মতো। বলছেন, মাস্কের স্কুল জীবনের বন্ধু লেসলি বার্নস। ১৯৮৫ সালে স্কুলের দাবা দলের সদস্য মাস্ককে নির্মমভাবে নির্যাতন করা হয়েছিল। তাকে সিঁড়ি থেকে ফেলে দেওয়া হয়েছিল, এতটাই মারধর করা হয়েছিল যে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। স্কুল কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে মুখ খুলতে চায়নি।
মাস্কের সাথে কম্পিউটার বিজ্ঞানের ক্লাস করা গিডিয়ন ফুরি জানাচ্ছেন, মাস্কের বাবা তাকে এবং তার ভাই কিম্বালকে প্রিটোরিয়া বয়েজে স্থানান্তরিত করেছিলেন, যেখানে তাকে খুব পছন্দ করা হত। ফুরির মতে, ‘মাস্ক খুব সাধারণ একজন মানুষ ছিল। সে নিজেকে কোনোদিনই আলাদা করে রাখতো না। তার একদল বন্ধু ছিল।’
দক্ষিণ আফ্রিকার গণমাধ্যমগুলিতে কঠোর সরকারি সেন্সরশিপ ছিল। সংবাদপত্রগুলিতে সেন্সর করা অংশগুলি কালো করে ছাপা হত, বিশেষ করে শহরতলিতে ক্রমবর্ধমান অস্থিরতা এবং গণগ্রেপ্তারের প্রতিবেদন। বিপরীতে, প্রিটোরিয়ার ফি-প্রদানকারী ছেলেরা সেই সময়ের তুলনায় অনেক উদার ছিল। ১৯৮১ সালে এটিই প্রথম সরকারি স্কুল যেখানে একজন কৃষ্ণাঙ্গ ছাত্র ভর্তি করা হয়েছিল। তৎকালীন প্রধান শিক্ষক ম্যালকম আর্মস্ট্রং দক্ষিণ আফ্রিকার ‘মাতৃভূমি’ থেকে কূটনীতিকদের ছেলেদের স্কুলে প্রবেশের সুযোগ করে দিয়েছিলেন।
স্কুলে মাস্কের দুই বছরের জুনিয়র প্যাট্রিক কনরয় বলেন, ‘আর্মস্ট্রং প্রায়শই আমাদের স্কুল সমাবেশে বক্তব্য রাখতেন। গণতন্ত্র, মানবাধিকার এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের গুরুত্বের উপর জোর দিতেন।’
মাস্ক পূর্বে নিজেকে ‘রক্ষণশীল নন’ বলে বর্ণনা করেছেন এবং ২০০৮ সালে বারাক ওবামার বিজয়ের পর থেকে প্রতিটি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটিক প্রার্থীকে সমর্থন করেছেন, যতক্ষণ না তিনি ডানপন্থী হয়ে ওঠেন। কিন্তু মাস্ক স্পষ্টতই গণতন্ত্র এবং এর সমর্থনকারী নেতাদের প্রতি সন্দেহ প্রকাশ করে এসেছেন। ১৯৩০-এর দশকে, তার দাদা কানাডায় ফ্যাসিবাদী গণতন্ত্রবিরোধী রাজনৈতিক আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, যা অভিজাত টেকনোক্র্যাটদের দ্বারা সরকারের পক্ষে প্রচারণা চালাত। এরপর তিনি বর্ণবাদী দক্ষিণ আফ্রিকায় চলে যান কারণ বর্ণবাদী ব্যবস্থা তার কাছে আকর্ষণীয় ছিল।
মাস্কের স্কুলের কিছু সহপাঠী অনুমান করেছিলেন যে দক্ষিণ আফ্রিকা সম্পর্কে তার বর্তমান দৃষ্টিভঙ্গি বর্ণবাদের অবসান এবং ১৯৯৪ সালে নেলসন ম্যান্ডেলার দেশের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট হওয়ার ‘অলৌকিক ঘটনা’ দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে। তারপর থেকে, ম্যান্ডেলার এএনসি দলের নেতৃত্বাধীন সরকারগুলি বিশ্বের সবচেয়ে খারাপ অর্থনৈতিক বৈষম্য মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হয়েছে। যদিও তাদের কৃষ্ণাঙ্গ অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন নীতিগুলি কৃষ্ণাঙ্গ মালিকানাধীন কোম্পানিগুলিকে কর ছাড় এবং রাষ্ট্রীয় চুক্তি প্রদান করে, তবুও কৃষ্ণাঙ্গদের বেকার হওয়ার সম্ভাবনা শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় পাঁচগুণ বেশি। দক্ষিণ আফ্রিকাও বিশ্বের সর্বোচ্চ হত্যার হারের দেশগুলির মধ্যে একটি। শ্বেতাঙ্গ দক্ষিণ আফ্রিকানদের বিরুদ্ধে বৈষম্যের অভিযোগ অস্বাভাবিক নয়। ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে, প্রিটোরিয়ায় মার্কিন দূতাবাসের বাইরে শত শত লোক জড়ো হয়েছিল ‘প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের জন্য ঈশ্বরকে ধন্যবাদ’ এবং ‘দক্ষিণ আফ্রিকাকে আবার মহান করুন’ স্লোগান সম্বলিত প্ল্যাকার্ড বহন করে।
কেপ টাউনের তার প্রশস্ত বাড়ি থেকে একটি ভিডিও সাক্ষাৎকারে এরোল মাস্ক বলেন, তার ছেলে ইলনের শৈশব সম্পর্কে বলতে গিয়ে জানান, সময়টা ভালো ছিল। কারণ আমাদের কোনও সমস্যা ছিল না। কৃষ্ণাঙ্গ এবং শ্বেতাঙ্গ উভয়ই একে অপরের সাথে খুব ভালোভাবে মিলে মিশে থাকতো। এটাই বাস্তবতা। অবশ্য মানুষ এটা শুনতে চায় না, কিন্তু এটাই সত্য।
মাস্ক এবং তার দুই ছোট ভাইবোন, কিম্বাল এবং টোস্কার তাদের বাবার সাথে সম্পর্ক খুব একটা গভীর নয়। কিম্বাল মাস্কের জীবনীকার ওয়াল্টার আইজ্যাকসনকে বলেছিলেন যে, তাদের বাবা দুই থেকে তিন ঘণ্টা ধরে তাদের উপর চিৎকার করতেন, তাদের অকেজো বলে বকাঝকা করতেন। তাদের মা, এরোল মাস্কের বিরুদ্ধে শারীরিক নির্যাতনের অভিযোগ এনেছেন। যদিও এইসব অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন তিনি। আইজ্যাকসনের মতে, ২০১৭ সালে যখন তার ৩০ বছর বয়সী সৎমেয়ে জানা বেজুইডেনহাউটের সাথে এরোলের একটি সন্তান হয়, তখন ভাইয়েরা তাদের বাবার থেকে দূরে সরে যান।
এরোলের কথায় , ‘২০১৬ সালে কেপটাউনে আমার ৭০তম এবং মাস্কের ৪৫তম জন্মদিন উপলক্ষে আয়োজিত এক পার্টিতে আমি যখন ট্রাম্পের প্রতি সমর্থন প্রকাশ করেছিলাম, তখন আমার ছেলে আমার উপর ক্ষুব্ধ হয়েছিলো। বাইডেন আসার পর আমেরিকার পরিস্থিতি বদলে গেল এবং ইলন বুঝতে পারলো যে তারা আমেরিকা ধ্বংস করার চেষ্টা করছে। এখন আমার ছেলের সাথে আমি প্রতিদিন বার্তা আদান-প্রদান করি। অবশ্যই, সে সবসময় উত্তর দিতে সক্ষম হয় না, তাই তার পিএ আমাকে উত্তর দেয়।’
সূত্র : দ্য গার্ডিয়ান