হাজার হাজার সৌদি প্রবাসীর ভাগ্য অনিশ্চিত

Published: 2 October 2020

বিশেষ সংবাদদাতা, ঢাকা : বৈশ্বিক করোনা মহামারির কারণে ছুটিতে আটকে পড়া সৌদি প্রবাসী বাংলাদেশিদের ভিসা ও আকামার (কাজের বৈধ অনুমতিপত্র) মেয়াদ বাড়ানোর কোনো আনুষ্ঠানিক ঘোষণা গতকাল বৃহস্পতিবার অবধি দেয়নি সৌদি সরকার। ফলে গত ৩০ সেপ্টেম্বর ভিসা ও আকামার মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়া হাজার হাজার প্রবাসীর সৌদি আরবে তাদের কর্মস্থলে ফেরা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।

আকামার মেয়াদ অথবা কর্মচারীর জন্য কফিল বা চাকরিদাতার আবেদন না থাকলে রি-এন্ট্রি ভিসা দেবে না বলে জানিয়েছে ঢাকাস্থ সৌদি দূতাবাস। এতে করে গত এক সপ্তাহ যাবত্ যেসব প্রবাসী রাজপথে বিক্ষোভ করে আসছিলেন, তাদের বিক্ষোভ থামছে না। তারা বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কোনো আশ্বাসবাণীতে আশ্বস্ত থাকতে পারছেন না। অনেকে হতোদ্যম হয়ে ঢাকা থেকে আবারও গ্রামে ফিরে গেছেন।

নতুন এক ঘোষণায় যাদের ভিসার মেয়াদ ৩০ সেপ্টেম্বরে শেষ হয়েছে, তাদের ভিসা নবায়নের সুযোগ দিয়েছে সৌদি কর্তৃপক্ষ। কিন্তু নবায়নের জন্য এমন কিছু কঠিন শর্ত রাখা হয়েছে, যেটি পূরণ করে একজন বাংলাদেশির সৌদি আরবে ফেরা একপ্রকার অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ঢাকার সৌদি দূতাবাস থেকে ভিসা নবায়নে যেসব শর্ত পূরণের কথা বলা হয়েছে, তার মধ্যে নিয়োগকর্তা বা কফিলের আবেদনসংবলিত চিঠির কথা বলা হয়েছে, যা সৌদি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক সত্যায়িত হতে হবে। আকামার মেয়াদ লেখা থাকতে হবে সৌদি পাসপোর্ট অধিদপ্তরের (জাওয়াজাত) আবেদনের প্রিন্ট কপিতে। পাসপোর্ট ও রি-এন্ট্রি ভিসার মূল কপি রাখতে হবে সঙ্গে। থাকতে হবে মেয়াদসহ আকামার মূল কপি।

এ ছাড়া সৌদি আরব থেকে বের হওয়ার মূল কপি থাকার বাধ্যবাধকতাও রাখা হয়েছে ভিসা নবায়ন শর্তে। এর মধ্যেই দেশে এসে আটকে পড়া বাংলাদেশি, যাদের ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে, তাদের ভিসা নবায়নে আবেদন নেওয়া শুরু করেছে ঢাকার সৌদি দূতাবাস।

তবে সরাসরি দূতাবাসে কোনো ভিসার আবেদন গ্রহণ করা হচ্ছে না। ভিসা নবায়নের প্রক্রিয়া শুরু করতে আবেদন গ্রহণের জন্য ৩১ এজেন্সিকে অনুমোদন দিয়েছে দূতাবাস। এসব এজেন্সির মাধ্যমে ভিসা নবায়নের আবেদন গ্রহণ করতে হবে। বাংলাদেশে অবস্থানরত প্রায় ২৫ হাজার সৌদি প্রবাসীকে পুনরায় ভিসা নিতে হবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান। তবে গতকাল পর্যন্ত ঢাকাস্থ সৌদি দূতাবাসের অনুমোদিত ৩২টি কনসালটেন্সি সেন্টারও কোনো দিকনির্দেশনা না পাওয়ায় প্রবাসী কর্মীদের ভিসার আবেদন দূতাবাসে জমা দেওয়ার কার্যক্রম শুরু করতে পারেনি।

এদিকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন বলেন, যারা দেশে চলে এসেছিলেন, তাদের মধ্য থেকে যাদের ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে কিন্তু সেখানে চাকরি আছে, তাদের নতুন করে ভিসা নিতে হবে। সৌদি কর্তৃপক্ষ ভিসা নতুন করে ইস্যু করবে বলে আমাদের জানিয়েছে। তবে যাদের ভিসার মেয়াদ শেষ এবং কফিল বা চাকরিদাতা আর নিয়োগ দেবেন না, তাদের বিষয়ে কিছু করার নেই। এমন শ্রমিকদের বিকল্প কর্মসংস্থান অথবা দেশেই কোনো কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার পরামর্শ দেন তিনি।

গত ২৩ সেপ্টেম্বর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছিল, বাংলাদেশে অবস্থানরত সৌদি প্রবাসী বাংলাদেশিদের আকামার মেয়াদ চলতি আরবি সফর মাসের শেষ দিন, অর্থাত্ আরো ১৭ অক্টোবর পর্যন্ত বাড়াবে। তবে এ ধরনের কোনো ঘোষণা সৌদি সরকার গতকাল পর্যন্ত দেয়নি। আকামা আর ভিসার মেয়াদ বাড়ানোর ঘোষণা সৌদির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দিয়ে থাকে। এখন পর্যন্ত তারা এমন কিছু বলেনি।

এ বিষয়ে ঢাকা থেকে সৌদির বিষয়ে বাংলাদেশ দূতাবাসের কাছে জানতে চেয়েছিল প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। দূতাবাস মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছে, সাধারণত এ ধরনের কোনো ঘোষণা সৌদি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয় না। বাংলাদেশিদের ক্ষেত্রে আকামার মেয়াদ ২৪ দিন বাড়িয়ে দেওয়া হবে এমন কোনো ঘোষণা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পাওয়া যায়নি। এভাবে সরকারের পক্ষ থেকে আকামা কিংবা ভিসার মেয়াদ বৃদ্ধির অনুমোদন ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াটি সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষসহ বিভিন্ন সংস্থা ও টেকনিক্যাল অথরিটির মাধ্যমে হয়ে থাকে।

বাংলাদেশ দূতাবাস মন্ত্রণালয়কে আরো জানায়, সৌদিতে প্রবেশে আকামার মেয়াদের পাশাপাশি এক্সিট রি-এন্ট্রি ভিসার মেয়াদও থাকতে হয়। আকামার মেয়াদ না থাকলে এক্সিট রি-এন্ট্রি ভিসারও মেয়াদ থাকে না। আগে সৌদি সরকারের পক্ষ থেকে আকামা ও এক্সিট রি-এন্ট্রি ভিসার মেয়াদ ফি দিয়ে বৃদ্ধি করে দেওয়া হয়েছিল। পরিস্থিতি বিবেচনায় সৌদি কর্তৃপক্ষ হয়তো আগের মতো কিংবা ভিন্ন কোনো পদ্ধতিতে আকামা ও ভিসা এক্সটেনশনের অনুমোদন দিতে পারে। তবে ঘোষণা না আসা পর্যন্ত তা নিশ্চিত নয়। এ বিষয়ে দূতাবাসের পক্ষ থেকে সৌদি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে।

জানা গেছে, সৌদি আরবে কর্মরত সব দেশের কর্মীর আকামার মেয়াদ বাড়ানোর ঘোষণা সে দেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দেয়। সরকারের তরফ থেকে আকামা অথবা ভিসার মেয়াদ বাড়ানোর অনুমোদন ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াটি সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষসহ বিভিন্ন সংস্থা ও টেকনিক্যাল অথরিটির মাধ্যমে হয়ে থাকে। সৌদি সরকারের পুরো সিস্টেম চলে অনলাইনে। অনলাইনে এসব মেয়াদ সংশোধনের জন্য একটি প্রসেস অনুসরণ করতে হয়। এর মধ্যে আইন সংশোধনের বিষয় আছে।

আকামার মেয়াদ বাড়ানোর কাজ অনলাইনে পরিচালনা করে সৌদির ন্যাশনাল ডাটা সেন্টার। এই সেন্টারের সঙ্গে প্রত্যেকটি কোম্পানি সংযুক্ত থাকে। এদিকে ভিসা ও আকামার মেয়াদ শেষ হওয়ায় অনেক অপেক্ষমাণ সৌদি প্রবাসী কর্মী গত এক সপ্তাহ ঢাকার রাজপথে বিক্ষোভ করে ফিরতি টিকিট না পেয়ে নিরাশ মনে বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন।

সৌদি আরব প্রবাসী খুলনার ফুলতলার আবদুর রহমান জানান, তিনি দেশে এসেছিলেন গত ফেব্রুয়ারিতে। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ফিরতি টিকিট করেছিলেন ১৭ এপ্রিল। এর মধ্যেই করোনার কারণে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বন্ধ থাকায় আটকে যায় তার সৌদি আরব ফেরা। আগামী ৩০ সেপ্টেম্বর শেষ হয়েছে তার ভিসার মেয়াদ। তাই ভিসা নবায়নের জন্য তিনি সৌদি নিয়োগকর্তাকে (কফিল) চিঠির জন্য ফোন করেন। কিন্তু কফিল এ জন্য তার কাছে দাবি করেন দুই হাজার রিয়াল, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৪৫ হাজার টাকা। এ ছাড়া সৌদি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নেওয়ার শর্ত কীভাবে পূরণ করা হবে সেটি বুঝতে পারছেন না। ফলে এক ধরনের গভীর অনিশ্চিয়তায় পড়েছেন তিনি।

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সি-বায়রার যুগ্ম-মহাসচিব মো. মিজানুর রহমান বলেন, আটকে পড়া প্রবাসী কর্মী ও ভিসা স্ট্যাম্পিং করা ৭৮ হাজার অপেক্ষমাণ কর্মীদের ভাগ্য নিয়ে আমরাও উদ্বিগ্ন।

এদিকে, কর্মস্থলে ফিরতে টিকিট প্রদান ও ভিসার মেয়াদ বৃদ্ধির দাবিতে গতকালও সৌদি প্রবাসীরা বিক্ষোভ করেছেন। কাওরান বাজারের সাউদিয়া অফিস, মতিঝিল বিমান অফিসের সামনে বিক্ষোভ করেছেন তারা। প্রবাসীদের মধ্যে যাদের বৈধ ভিসা ও আকামা আছে তাদের পরিবহনের জন্য গতকাল বৃহস্পতিবার থেকে সৌদি আরবে শুরু হয়েছে সপ্তাহে ২০টি ফ্লাইট চলাচল। এর মধ্যে সৌদিয়া এয়ারলাইনসের ১০টি ও বিমান বাংলাদশে এয়ারলাইনসের ১০টি করে ফ্লাইট চলবে।