১০ হাজার কোটি ডলারের ‘সুইস সিক্রেট’ ফাঁস

Published: 21 February 2022

পোস্ট ডেস্ক :


নতুন করে ১০ হাজার কোটি ডলারের ‘সুইস সিক্রেট’ ফাঁস হয়েছে। এতে অন্য অনেকের সঙ্গে উঠে এসেছে জর্ডানের বাদশা দ্বিতীয় আবদুল্লাহ, মিশরের সাবেক স্বৈরাচার হোসনি মুবারকের ছেলেদের নাম। নিউ ইয়র্ক টাইমসের পাকিস্তানি সংস্করণ এক্সপ্রেস ট্রিবিউনে প্রকাশিত এক দীর্ঘ প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে। এতে আরও বলা হয়, সুইস ব্যাংকগুলোর ক্লায়েন্টদের তালিকা বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সুরক্ষা দিয়ে গোপনীয় রাখা হয়। এতে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী অনেকের পরিচয় লুকিয়ে রাখা হয়। ফলে দুনিয়ার মানুষ জানতে পারে না, তারা কিভাবে নিজেদের আখের গুছিয়েছে।

কিন্তু বিশ্বের সবচেয়ে আইকনিক ব্যাংকগুলোর অন্যতম ক্রেডিট সুইস থেকে বিপুল পরিমাণ ব্যতিক্রমী ডাটা ফাঁস হয়েছে। এর ফলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান, গোয়েন্দা কর্মকর্তা, নিষেধাজ্ঞায় থাকা ব্যবসায়ী, মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী এবং আরও অনেকের শত শত কোটি ডলার কিভাবে তাদের কাছে জমা রেখেছে তা প্রকাশ হয়ে গেছে।

স্বঘোষিত এক হুইসেলব্লোয়ার ওই ব্যাংকের কমপক্ষে ১৮,০০০ একাউন্ট ফাঁস করে দিয়েছেন। এসব একাউন্টে সব মিলে জমা আছে কমপক্ষে ১০,০০০ কোটি ডলার। এমন হিসাব জার্মান পত্রিকা সুডয়েচে জিতাং-এর। ওই পত্রিকাটি সাংবাদিকদের অলাভজনক গ্রুপ- অর্গানাইজড ক্রাইম অ্যান্ড করাপশন রিপোর্টিং প্রজেক্ট এবং বিশ্বের অন্য ৪৬টি সংবাদ ভিত্তিক প্রতিষ্ঠানের কাছে শেয়ার করেছে এসব ডাটা। এর মধ্যে আছে নিউ ইয়র্ক টাইমস। ফাঁস হওয়া একাউন্টগুলো ১৯৪০-এর দশকে শুরু হয়ে ২০১০-এর দশক পর্যন্ত খোলা হয়েছে।

ক্রেডিট সুইস একাউন্টে যে শত শত কোটি ডলার জমা আছে, তার মালিকদের মধ্যে আছেন জর্ডানের বাদশা দ্বিতীয় আবদুল্লাহ, হোসনি মুবারকের দুই ছেলে, ভেনিজুয়েলার কিছু কর্মকর্তা। ফাঁস হওয়া ডকুমেন্টে দেখা যাচ্ছে ক্রেডিট সুইসে এসব একাউন্ট শুধু অতি ধনীরাই খুলেছিলেন এমন নয়। একই সঙ্গে সঙ্কটে আছেন এমন ব্যক্তিদেরও নাম আছে। সুইজারল্যান্ডের অর্থপাচার বিরোধী এজেন্সির সাবেক প্রধান দানিয়েল থেলেস্করাফ বলেছেন, দীর্ঘদিন ধরে ক্রিমিনাল কর্মকা-ের সঙ্গে যুক্তদের অর্থ নেয়ার ক্ষেত্রে আইনি বিধিনিষেধ মোকাবিলা করছে সুইস ব্যাংকগুলো। তবে সাধারণত আইন প্রয়োগ করা হয় না।

ক্রেডিট সুইস ব্যাংকের মুখপাত্র ক্যান্ডিস সান বিবৃতিতে তাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ জোর দিয়ে প্রত্যাখ্যান করেছেন। একই সঙ্গে ব্যাংকের অনুমেয় ব্যবসায়িক চর্চা সম্পর্কে ধারণাও প্রত্যাখ্যান করেছেন তিনি। আরও বলেছেন, এসব একাউন্টের বহু, কয়েক দশক আগের। এটা এমন এক সময়ের, যখন আইন, আইনি চর্চা এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রত্যাশা এখনকার চেয়ে অনেক বেশি ভিন্ন ছিল। ক্যান্ডিস সান বলেন, সুনির্দিষ্ট ক্লায়েন্টদের সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করতে পারে না ক্রেডিট সুইস। ফাঁস হওয়া ডাটাবেজের অনেক একাউন্ট বন্ধ বলে চিহ্নিত হয়েছে। তার ভাষায়- যেসব একাউন্ট এখনও সক্রিয় আছে, তা নিয়ে আমরা স্বস্তিতে আছি। এসব একাউন্ট সম্পর্কে যথাযথ মনোযোগ, পর্যালোচনা ও অন্যান্য নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কিত পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। মুলতবি আছে এমন একাউন্টগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ক্যান্ডিস সান বলেন, ক্রেডিট সুইস ব্যাংক এবং সুইস আর্থিক বাজারের সুনাম ক্ষুন্ন করার জন্য এসব তথ্য ফাঁস করা হয়েছে।

এর আগে ২০১৬ সালে ফাঁস হয় পানামা পেপারস, ২০১৭ সালে প্যারাডাইস পেপারস এবং গত বছরে প্যান্ডোরা পেপারস। তারপরই সুইস এসব একাউন্টের তথ্য ফাঁস হলো। এসব ফাঁস থেকে উন্মুক্ত হয়ে পড়ে ব্যাংক, আইনি প্রতিষ্ঠান এবং অফসোর আর্থিক-সাভিস খাতের গোপনীয় কর্মকা-। এসব খাতে ধনী মানুষ এবং প্রতিষ্ঠান আয়কর ফাঁকি দিয়ে আইন প্রয়োগকারীদের চোখ ফাঁকি দিয়ে অর্থ জমা রাখেন। তারা বিপুল পরিমাণ অর্থ সরিয়ে এসব খাতে নিয়ে গিয়েছেন। তবে সুইস ব্যাংকের সর্বশেষ ফাঁস হওয়া তথ্যের ফলে নতুন করে এ শিল্পের আইনি এবং রাজনৈতিক যাচাই বাছাইয়ের দাবি জোরালো হতে পারে। এরই মধ্যে ক্রেডিট সুইস ব্যাংকের শীর্ষ দুই নির্বাহীকে আকস্মিকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। ফলে ব্যাংকটি বিপর্যস্ত অবস্থায় আছে।

ব্যাংকিং খাতে গোপনীয়তা বিষয়ক কঠোর আইনের ফলে অর্থ লুকিয়ে রাখার জন্য বিশ্বের ধনীদের জন্য দীর্ঘদিন স্বর্গ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে সুইজারল্যান্ড। এর ফলে গত এক দশকে সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকিং খাতের দুই জায়ান্ট ক্রেডিট সুইস এবং ইউবিএসসহ বিভিন্ন বড় বড় ব্যাংককে টার্গেট করেছে যুক্তরাষ্ট্র। আয়কর ফাঁকি, অর্থ পাচার এবং অন্য অপরাধগুলোতে কারা জড়িত, তা বের করার চেষ্টা করছে যুক্তরাষ্ট্র। ২০১৪ সালে মার্কিনিদের আয়কর রিটার্নের মিথ্যা ফাইল করার ক্ষেত্রে সহায়তার ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকার জন্য দোষী সাব্যস্ত হয় ক্রেডিট সুইস। তারা মোট ২৬০ কোটি ডলার জরিমানাসহ অন্যান্য অর্থ হিসেবে পরিশোধে রাজি হয়। তিন বছর পরে যুক্তরাষ্ট্রের আইন মন্ত্রণালয়কে বন্ধকী-সমর্থিত সিকিউরিটিজ বিপনন অভিযোগ নিষ্পত্তি করতে পরিশোধ করে ৫৩০ কোটি ডলার। এ ছাড়া তারা মোজাম্বিকে ঘুষ সংক্রান্ত এক তদন্তের সমাধান করতে যুক্তরাষ্ট্র ও বৃটিশ কর্তৃপক্ষকে ৪৭ কোটি ৫০ লাখ ডলার পরিশোধে সম্মত হয়। এ মাসে সুইজারল্যান্ডে একটি মামলার বিচার চলছে। সেখানে এই ব্যাংকের মাধ্যমে মাদক পাচারকারীদেরকে লাখ লাখ ইউরো পাচারে সহায়তার জন্য অভিযুক্ত করা হয়েছে ক্রেডিট সুইসকে। যুক্তরাষ্ট্রের আইন মন্ত্রণালয় এবং সিনেট ফিন্যান্স কমিটি পরীক্ষা করে দেখছে এই ব্যাংকে কোনো মার্কিনির অঘোষিত একাউন্ট আছে কিনা।

সর্বশেষ ফাঁস ডকুমেন্টকে মিডিয়া কনসোর্টিয়াম না দিয়েছে ‘সুইস সিক্রেটস’। ব্যাংকটিতে যে কমপক্ষে ১৮ হাজার একাউন্ট আছে, এর মধ্যে মোটামুটি ১০০টি মার্কিন নাগরিকরদের। কিন্তু তাদের কেউই সরকারি কর্মকর্তা নন। এসব একাউন্টে সন্দেহজনক এক্টিভিটির বিষয় ব্যাংক কর্মকর্তারা নোটিশ করার পরেও তাদের সঙ্গে কার্যক্রম চালিয়ে গেছে ক্রেডিট সুইস। একজন একাউন্ট হোল্ডার হলেন ভেনিজুয়েলার সাবেক জ্বালানি বিষয়ক উপমন্ত্রী নারভিস ভিলালোবোস। ক্রেডিট সুইসের কর্মচারীদের কমপ্লায়েন্স ডিপার্টমেন্টের ওই ব্যক্তির সঙ্গে বাণিজ্য চালানো নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ ছিল। ভিলালোবোস এবং ভেনিজুয়েলার রাষ্ট্র মালিকানাধীন তেল কোম্পানি পেট্রোলোস ডি ভেনিজুয়েলার দুর্নীতি নিয়ে বাইরের একটি প্রতিষ্ঠান এই ব্যাংকে রিপোর্ট করেছিল ২০০৮ সালে। তা সত্ত্বেও ২০১১ সালে তার নামে একটি একাউন্ট খোলে ক্রেডিট সুইস। ফাঁস হওয়া ডকুমেন্টে দেখা যায়, ওই একাউন্টটি বন্ধ হয়ে যায় ২০১৩ সালে। ততদিনে এতে জমা হয়েছে এক কোটি ডলার।

জিম্বাবুয়ের দীর্ঘদিনের প্রেসিডেন্ট রবার্ট মুগাবের সঙ্গে সম্পর্ক থাকার কারণে একজন ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপিয়ান কর্তৃপক্ষ। তা সত্ত্বেও তার একাউন্ট সচল রাখে ওই ব্যাংক। নিষেধাজ্ঞা দেয়ার পর বেশ কয়েক মাস ওই একাউন্ট সচল ছিল। এই ফাঁস হওয়া ডকুমেন্টে দেখা যায় মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের সরকারি কর্মকর্তাদের নাম আছে। কিভাবে সরকারি কর্মকর্তারা এবং তাদের আত্মীয়রা এত বিপুল পরিমাণ অংকের অর্থ সরিয়ে নিলেন তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে ওই ডাটায়। এতে দেখা গেছে মিশরের সাবেক প্রেসিডেন্ট হোসনি মুবারকের দুই ছেলে আলা এবং গামাল মুবারকের মোট ৬টি একাউন্ট আছে সেখানে। এর মধ্যে ২০০৩ সালের একটি একাউন্ট আছে, যেখানে জমা অর্থের পরিমাণ ১৯ কোটি ৬০ লাখ ডলার।