শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস আজ

Published: 14 December 2024

পোস্ট ডেস্ক :


মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা কবে সম্পন্ন হবে, তা কেউ বলতে পারছে না। চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে এই তালিকা শেষ করার কথা ছিল। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তালিকার কাজ এবং তালিকা প্রণয়ন কমিটি নিয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। স্বাধীনতার ৫৩ বছরেও শহীদ বুদ্ধিজীবীদের একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তাদের স্বজন ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

অন্তর্বর্তী সরকারের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা বীর মুক্তিযোদ্ধা ফারুক ই আজম বীরপ্রতীক গত বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে মন্ত্রণালয়ের সার্বিক কার্যক্রম নিয়ে কথা বলেন। সেখানে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পূর্ণাঙ্গ তালিকার বিষয়ে সাংবাদিকরা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘৫৬০ জনের তালিকা গেজেটের মাধ্যমে সম্পন্ন করা আছে।…৫০ বছর পর এসব তালিকা করাটা অতি দুরূহ একটা ব্যাপার।’

পরে কালের কণ্ঠের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় ফারুক-ই-আজম বলেন, ‘৫০ বছর পর এসে এই তালিকা করা হচ্ছে—এটা কি জাতির জন্য লজ্জাজনক নয়? আমি লজ্জিত হচ্ছি, দুঃখও পাচ্ছি।

অর্ধশতাব্দী চলে গেলেও এই মানুষগুলোকে ন্যায্য সম্মানটা কী কারণে দেওয়া হলো না? এই অবহেলার শিকার তারা কী কারণে হলো? এগুলো জাতির দেহের মধ্যে ক্ষত। যতই আমরা খোঁচাব ততই রক্তক্ষরণ হবে।’
এই তালিকা প্রণয়নের কাজ চলমান থাকবে কি না, জানতে চাইলে উপদেষ্টা বলেন, ‘এগুলো চলমান প্রক্রিয়া ছিল না। এখন আপনি তালিকাটা নিন, সেটা নিয়ে বসেন, ১৪ রকমের লিটিগেশন (মামলা-মোকদ্দমা) বের হবে।

তবে যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা গবেষণা করতে চাইলে আমরা সেই গবেষণায় সহযোগিতা দেব। যারাই গবেষণা করতে চাইবে, আমাদের কাছে যত তথ্য-উপাত্ত আছে আমরা সেগুলো দিয়ে তাদের সহযোগিতা করব।’
মন্ত্রণালয়ের একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা প্রণয়নের কাজ এই মুহূর্তে মন্ত্রণালয়ের চিন্তা-ভাবনায় নেই। ভবিষ্যতে কখনো তালিকাটি করা হলেও বর্তমান কমিটিতে যেসব সদস্য আছেন তাদের না থাকার সম্ভাবনাই বেশি। সে ক্ষেত্রে পুনর্গঠিত হতে পারে এই কমিটি।

জানতে চাইলে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা প্রণয়নের লক্ষ্যে গঠিত কমিটির সভাপতি ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব ইসরাত চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘তালিকার কাজটা আমরা শুরু করেছিলাম, এটা ঠিক। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা থাকাও দরকার। (তালিকা চলমান থাকবে কি না তা নিয়ে) এই মুহূর্তে কোনো চিন্তা-ভাবনা নেই। এর কোনো কার্যক্রম নেই এখন। এটা নিয়ে আমরা আলোচনাও করিনি। তালিকা প্রণয়নে গঠিত কমিটির কার্যক্রমও নেই এই মুহূর্তে। জুলাইয়ের পর কমিটির কোনো সভাও হয়নি আর।’

মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানিয়েছে, গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের যাচাই-বাছাই কমিটির সদস্যদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করা হয়নি। এ বিষয়ে কোনো সভাও আহ্বান করা হয়নি মন্ত্রণালয় থেকে। এ তালিকা তৈরির লক্ষ্যে গঠিত জাতীয় কমিটির সর্বশেষ সভা হয় গত ১৮ মার্চ। এরপর ২৪ মার্চ তৎকালীন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক সংবাদ সম্মেলন করে তালিকার চতুর্থ পর্ব প্রকাশ করেন। এরপর পঞ্চম পর্বের জন্য যাচাই-বাছাই উপকমিটির একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়।

এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কমিটির এক গবেষক সদস্য কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের কমিটি মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের গঠন করা। এই কমিটি মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী তালিকা তৈরি করে থাকে। পঞ্চম পর্বের জন্য আমাদের নির্দেশনা ছিল। সে অনুযায়ী উপকমিটি হোমওয়ার্কও শেষ করেছিল। অনেকখানিই এগিয়ে রেখেছিলাম আমরা। কিন্তু আগস্টে সরকার পরিবর্তনের পর মন্ত্রণালয় থেকে আমাদের কোনো তাগাদা দেওয়া হয়নি। তবে আমাদের যদি ডাকে তাহলে আমরা অগ্রসর হব।’

এই গবেষক সদস্য আরো বলেন, ‘ইচ্ছা ছিল আমরা এটা অনন্তকাল টানব না। আমাদের লক্ষ্য ছিল এ বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে ছয় পর্বে (আগের চার পর্বসহ) এটাকে শেষ করা।’

এর আগে আ ক ম মোজাম্মেল হক চতুর্থ পর্ব প্রকাশের পর এই ১৪ ডিসেম্বরের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রণয়নের লক্ষ্যের কথা জানিয়েছিলেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক যাচাই-বাছাই কমিটির আরেক সদস্য কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এখন যিনি উপদেষ্টা আছেন তিনি নিজে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। সুতরাং আমি মনে করি, নতুন সরকার এটি এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। নেওয়া উচিত।’

এ বিষয়ে কমিটির একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘(পঞ্চম পর্বের) কাজ অনেক দূর করে রাখা আছে। আরেকটি সভা হলেই আমার মনে হয় পরের পর্ব করে ফেলা যাবে। কমিটির ভেতরের হোমওয়ার্কগুলো এগিয়েছে ভালোই। মন্ত্রণালয় সভা আহ্বান করলে আমার মনে হয় এটা হয়ে যাবে।’

কমিটির সদস্য পরিবর্তন বা পুনর্গঠন সম্পর্কে জানতে চাইলে মফিদুল হক বলেন, ‘এই কমিটির যদি কোনো পরিবর্তনও হয় ওখানে (মন্ত্রণালয়ে) সরকারের লোক তো থাকছেই। ইনস্টিটিউশনাল মেমোরি (প্রাতিষ্ঠানিক স্মৃতি) ওখানে আছে। সুতরাং তা দিয়ে এটা তাদের চালিয়ে যাওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। এটা জাতির একটা অঙ্গীকারও।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কমিটির আরেকজন গুরুত্বপূর্ণ গবেষক সদস্য কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আগস্ট মাসের পর থেকে এ বিষয়ে তেমন কিছু করা হয়নি। মন্ত্রণালয় থেকেও যোগাযোগ করা হয় না। কমিটি থাকতে পারে, কিন্তু নিয়ম হচ্ছে মন্ত্রণালয় থেকে সচিবরা চিঠি দেন যে অমুক সময়ে আপনারা আসবেন বা সভা হবে। কিন্তু তা তো হচ্ছে না। আমি মনে করি, জাতির বিবেক ও ইতিহাসের সঙ্গে জড়িত এসব তালিকা সম্পন্ন করা উচিত।’

তালিকার বর্তমান অনিশ্চয়তা সম্পর্কে শহীদ মুনীর চৌধুরীর ছেলে ও মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সন্তানদের সংগঠন প্রজন্ম ’৭১-এর সভাপতি আসিফ মুনীর তন্ময় কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘তালিকাটা কোনো একটা সময়ে অবশ্যই হওয়া দরকার। ৫৩ বছরে হয়নি, কিন্তু একটা প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। তবে প্রক্রিয়াটাও বিতর্কের ঊর্ধ্বে কি না, সেটাও একটু নিশ্চিত হতে হবে। এটাও ঠিক, একটা অন্তর্বর্তী সময়ে সব কিছু হওয়া সম্ভব নয়।’

তন্ময় বলেন, ‘এখন না হলেও ভবিষ্যতে সেটা কোনো একটা সময়ে হতে হবে। সে ক্ষেত্রে এরই মধ্যে হওয়া গেজেটগুলোও একটু রিভিউ করতে হবে। শহীদ বুদ্ধিজীবী পরিবারের সদস্যদের পরামর্শের ভিত্তিতে এটা করা উচিত, যাতে সেখানে কোনো বিতর্ক না থাকে। এই তালিকা শুধু শহীদ পরিবারের সদস্যদের দাবি নয়, একটি জাতীয় দাবি—জাতির বিবেক ও জবাবদিহির জায়গা থেকে।’

 

চার পর্বে শহীদ বুদ্ধিজীবী ৫৬০ জন, সবচেয়ে বেশি শিক্ষক

এর আগে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের গেজেট অধিশাখা ২০২১ ও ২০২২ সালে তালিকার প্রথম পর্বে ১৯১ জন এবং দ্বিতীয় পর্বে ১৪৩ জনের নাম প্রকাশ করে। মাঝে দেড় বছরের বিরতির পর চলতি বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি তালিকার তৃতীয় পর্ব প্রকাশিত হয়, যেখানে আরো ১০৮ জনের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এরপর ২৪ মার্চ আরো ১১৮ শহীদ বুদ্ধিজীবীর নামসংবলিত তালিকার চতুর্থ পর্ব গেজেট আকারে প্রকাশ পায়। সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত চার পর্বে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা ৫৬০।

তালিকায় থাকা শহীদ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে সংখ্যায় সবচেয়ে বেশি শিক্ষক, ১৯০ জন। এর পরের অবস্থানেই রয়েছেন চিকিৎসক। চার পর্বে মোট ১১১ জন চিকিৎসক এখন পর্যন্ত তালিকাভুক্ত হয়েছেন। আইনজীবী ৫০ জন, প্রকৌশলী ৩৯ জন এবং সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন ৩৪ জন। তালিকায় রাজনীতিক ও সমাজসেবী রয়েছেন ২৪ জন করে। এ ছাড়া সাহিত্যিক ২০ জন, সাংবাদিক ১৯ জন এবং সংস্কৃতিকর্মী ১৭ জন রয়েছেন শহীদ বুদ্ধিজীবীর তালিকায়। তালিকায় বিভিন্ন ধর্মের ধর্মগুরু রয়েছেন ১০ জন। এর মধ্যে ইমাম, মাওলানা ও মাদরাসা শিক্ষক আটজন এবং পুরোহিত ও পাদ্রি রয়েছেন দুজন।

আগের তালিকাগুলোতে ডা. আবদুল আলীম চৌধুরী, সুরকার আলতাফ মাহমুদ, সাহিত্যিক ও চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান, অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, রাজনীতিবিদ ও পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, সমাজসেবক নূতন চন্দ্র সিংহ, সাহিত্যিক ও শিক্ষক মোহাম্মদ আনোয়ার পাশা, সমাজসেবক ও দানবীর রণদা প্রসাদ সাহা, অধ্যাপক গোবিন্দচন্দ্র দেব, অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, সাহিত্যিক ও সাংবাদিক শহীদুল্লা কায়সারসহ প্রথিতযশা শহীদ বুদ্ধিজীবীরা ছিলেন। সেই সঙ্গে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের স্বল্প ও অপরিচিত অনেক বুদ্ধিজীবীও ছিলেন।

 

যাচাই-বাছাই কমিটি ও তালিকা তৈরির প্রক্রিয়া

শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা প্রণয়নের লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট গবেষক, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে ১১ সদস্যের যাচাই-বাছাই কমিটি গঠন করে ২০২০ সালের ১৯ নভেম্বর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় একটি প্রজ্ঞাপন প্রকাশ করে। কমিটিতে গবেষক সদস্য হিসেবে ছিলেন ইতিহাসবিদ ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সাবেক সভাপতি শাহরিয়ার কবির, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক গাজী সালেহ উদ্দিন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মেসবাহ কামাল, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক ও স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. বায়জীদ খুরশীদ রিয়াজ এবং গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘরের ট্রাস্টি চৌধুরী শহীদ কাদের।

বীর মুক্তিযোদ্ধা সদস্য হিসেবে ছিলেন চলচ্চিত্র নির্মাতা ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব বীর মুক্তিযোদ্ধা নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও গবেষক অবসরপ্রাপ্ত লে. কর্নেল কাজী সাজ্জাদ আলী জহির (বীরপ্রতীক)। কমিটিতে সভাপতি হিসেবে আছেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব। এ ছাড়া সদস্যসচিব হিসেবে গেজেট অধিশাখার উপসচিব ও সদস্য হিসেবে আরেকজন সচিব আছেন কমিটিতে।

২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে কমিটিতে আরো যুক্ত হন শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের নাতনি আরমা দত্ত, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক এবং শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. আলীম চৌধুরীর মেয়ে নুজহাত চৌধুরী। কমিটির একজন সদস্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক গাজী সালেহ উদ্দিন ২০২১ সালে মারা যান।

পরে ২০২১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি বীর মুক্তিযোদ্ধা কাজী সাজ্জাদ আলী জহিরকে আহ্বায়ক করে এই কমিটির ছয় সদস্যকে নিয়ে একটি উপকমিটি করা হয়। উপকমিটি খসড়া তালিকা করে তা আবার যাচাই-বাছাইয়ের জন্য মূল কমিটির কাছে উপস্থাপন করে।