নতুন বছরে অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা

Published: 2 January 2022

।।ড. আতিউর রহমান।।

বাংলাদেশ সংকট মোকাবেলা করেই সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার এক বিরল সংস্কৃতি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। অর্থনীতির বেলায় কথাটি আরো বেশি প্রযোজ্য। বঙ্গবন্ধু যে লড়াকু মন আমাদের দিয়ে গেছেন তার ওপর ভরসা করেই দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলেছে আজকের বাংলাদেশ। তাই বিশ্বব্যাপী এই করোনাকালেও বাংলাদেশের অর্থনীতি সঠিক পথেই রয়েছে। ২০২০ সালের চেয়ে ২০২১ সালে আমাদের অর্থনীতি বেশ চাঙ্গা ছিল বলা চলে। প্রবৃদ্ধির বিচারে সদ্যঃসমাপ্ত বছরটি খুবই আশাজাগানিয়া ছিল। এর আগের বছরও যখন সারা বিশ্বের অর্থনীতি সাড়ে ৩ শতাংশ হারে সংকুচিত হয়েছিল, তখনো আমাদের অর্থনীতি ৫ শতাংশের আশপাশেই বেড়েছিল। সেই সাফল্যের ওপর ভর করে গেল বছর আমাদের প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশের বেশি হতে kalerkanthoপেরেছে বলে আমার বিশ্বাস। যদিও পুরো তথ্য আমাদের হাতে নেই, তবু এ কথা বলা চলে যে কৃষি, প্রবাস আয়, রপ্তানি, আমদানিসহ সব ক্ষেত্রেই আমরা ভালো করেছি।

কৃষি বরাবরই ভালো করেছে। বৃষ্টির কারণে পেঁয়াজ ও সবজির সরবরাহ খানিকটা ব্যাহত হলেও বছর শেষে কৃষির উৎপাদন বেশ সন্তোষজনকই বলা চলে। চালের মজুদ যথেষ্ট। তবু মানুষের হাতে নগদ টাকা বেশি থাকায় চাল ও নিত্যপণ্যের দাম খানিকটা বেশি। ডলারের দাম বেশি বলে আমদানি করা নিত্যপণ্যের দাম কিছুটা বেড়েছে। সে কারণে মূল্যস্ফীতিও কিছুটা বাড়ন্ত। তবে একেবারে লাগামহীন নয়। সরবরাহ চেইনের অপর্যাপ্ততার কারণে সারা বিশ্বেই মূল্যস্ফীতি বাড়ন্ত। বাংলাদেশেও তার প্রভাব পড়েছে। সে কারণে প্রান্তিক মানুষের জীবনচলা খানিকটা চাপের মধ্যে রয়েছে। জীবিকার সুযোগ বাড়ছে। পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ার গতিও বাড়ছে। যদি করোনার নতুন ওমিক্রন ঢেউ অতি প্রবল না হয়, তাহলে বাংলাদেশের অর্থনীতির পুনরুদ্ধারের ধারা অটুটই থাকবে। আর সে কারণে টিকা দেওয়ার গতি ধরে রাখতে হবে। বুস্টার ডোজও সচল রাখতে হবে।

গত বছর পাঁচ লাখেরও বেশি শ্রমিক বিদেশে গেছেন কাজের সুযোগ পেয়ে। বছর শেষে মালয়েশিয়ার বাজার খোলার সংবাদ মিলেছে। ব্রিটেন প্রচুর কেয়ার-গিভার নেবে জানিয়েছে। তাই সামনের বছর প্রবাস আয়ে আরো গতি আসবে বলে মনে হয়। রপ্তানি খুব ভালো করছে। নতুন অর্ডার এসেছে প্রচুর। সারা বিশ্বেই ব্যবসা-বাণিজ্য যাতে বন্ধ না হয়ে যায় সেদিকে জনমত প্রবল। তাই আমাদের রপ্তানি পণ্যের চাহিদা ইতিবাচক থাকবে বলে আশা করা যায়। চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে গত অর্থবছরের একই সময় থেকে আমদানি মূল্য বেড়েছে ৫৪ শতাংশ। মূলধনী পণ্যের আমদানি বেড়েছে ৩০ শতাংশ। সুতার আমদানি বেড়েছে শতভাগেরও বেশি। তার মানে শিল্প খাতে নতুন বিনিয়োগ হচ্ছে। ফলে আগামী বছর প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান দুই-ই বাড়বে।

পুঁজিবাজারের সূচক ও পরিমাণ দুই-ই বেড়েছে গেল বছর। এ সম্পর্কিত রেগুলেটরদের নজরদারি ও সংস্কারমুখী কর্মমুখরতা এই বাজারকে সচল রাখতে সাহায্য করেছে। এশিয়ায় আমাদের পুঁজিবাজারের সচলতা চোখে পড়ার মতো ছিল গেল বছর। এই বাজারে বন্ডসহ দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ আকর্ষণের চেষ্টা লক্ষণীয় ছিল। সব অংশীজন সম্মিলিতভাবে সচেষ্ট থাকলে আমাদের পুঁজিবাজার আগামী দিনে আরো ভালো অবস্থানে যাবে। তবে নিয়ম ভাঙার প্রবণতা রোধ করার জন্য রেগুলেটরদের আরো সতর্ক থাকতে হবে।

ব্যাংকিং খাত সংকটকালে বেশ ভালো করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজারে প্রচুর তারল্য থাকার জন্য নীতি হারগুলো কমিয়েছে, সুদে ভর্তুকি দিয়েছে, প্রভিশন কমিয়েছে, দেয় ইনস্টলমেন্টের মাত্র ১৫ শতাংশ শোধের সুযোগ দিয়ে ঋণকে অখেলাপি রেখেছে। এসবের কারণে ব্যাংকের সার্বিক লাভ বেড়েছে। তবে এসব নীতি সহায়তার সুযোগ বড় উদ্যোক্তারা যতটা নিতে পেরেছে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা ততটা নিতে পারেননি। সে জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিম চালুসহ নতুন নতুন সমর্থনমূলক ব্যবস্থা নিচ্ছে। এসবের ইতিবাচক প্রভাব ব্যক্তি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধির ওপর পড়তে শুরু করছে। দুই বছর বাদে গত নভেম্বরে এই হার ১০.১১ শতাংশ হয়েছে। ডিসেম্বরে নিশ্চয় এ হার আরো বেড়েছে। তা থেকেই অনুমান করা যায় যে বছর শেষে ব্যবসা-বাণিজ্য অনেকটাই ঘুরে দাঁড়িয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর গতিশীল নেতৃত্বে মুদ্রানীতি ও রাজস্বনীতির যে সময়োপযোগী সমন্বয় ঘটেছে তার সুফল আমাদের অর্থনীতির ওপর পড়তে শুরু করেছে। করোনা সত্ত্বেও অর্থনীতি তাই চাঙ্গা হতে পেরেছে।

আমরা গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে আমাদের নমিনাল মাথাপিছু আয়ের বিচারে এশিয়ার মধ্যে পয়লা নম্বরের দেশ হিসেবে স্বীকৃত। বড় অর্থনীতির ৪১টি দেশের মধ্যে গেল বছর মাত্র আটটি দেশ ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। বাংলাদেশ এদের একটি। শুধু তা-ই নয়, বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার সবার ওপরে। রপ্তানি ও প্রবাস আয়ের প্রবৃদ্ধির বিচারেও আমরা আমাদের পড়শিদের চেয়ে এগিয়ে রয়েছি। খাদ্য উৎপাদন সূচক, বিশ্ব ক্ষুধা সূচক এবং মুদ্রামানের স্থিতিশীলতায় আমরা দক্ষিণ এশিয়ায় এক নম্বর। দারিদ্র্য নিরসন, গড় আয়ু, শিশু ও মাতৃমৃত্যু, নারীর আনুষ্ঠানিক শ্রমবাজারে অংশগ্রহণ এবং সার্বিকভাবে নারীর ক্ষমতায়নেও এ অঞ্চলে আমরাই সেরা। তা ছাড়া মোবাইল আর্থিক সেবা, এজেন্ট ব্যাংকিং, ক্ষুদ্রঋণ ও তরুণ উদ্যোক্তাদের (বিশেষ করে নারী) অর্থনীতিতে অংশগ্রহণের মাত্রার বিচারেও বাংলাদেশ আশপাশের দেশগুলো থেকে অনেকটাই এগিয়ে। এ ক্ষেত্রেও ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ী নেতৃত্বের অবদান অসামান্য।

করোনার নানামুখী চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও বেশ কিছু ক্ষেত্রে বাংলাদেশে অর্থনীতি ২০২২ সালে স্বস্তির মধ্যেই থাকবে বলে আমার বিশ্বাস।

এক. কৃষি বরাবরের মতোই আমাদের জীবন-জীবিকার রক্ষাকবচ হিসেবে তার শক্তিমত্তা দেখিয়ে যাবে। খাদ্য উৎপাদনে আমরা আমাদের সাফল্য ধরে রাখতে পারব বলে মনে হয়। বিশেষ করে চাল, মাছ, মাংস, সবজি, ডিম ও মুরগি সরবরাহে যদি বাজারব্যবস্থা সুশৃঙ্খল রাখতে পারি, তাহলে খাদ্য মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণেই রাখতে পারব।

দুই. টিকা কর্মসূচির গতি বাড়াতে পারলে ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর করোনার নেতিবাচক প্রভাব থেকে আমরা অনেকটাই মুক্ত থাকতে পারব। ফের লকডাউন দেওয়ার আশঙ্কা নেই বললেই চলে।

তিন. আমাদের রপ্তানির গতি অটুট থাকবে বলে মনে হয়। সে জন্য এই খাতে দেওয়া নীতি সুবিধাগুলো অব্যাহত রাখাই শ্রেয় হবে। ছোট-বড় উদ্যোক্তাদের ঋণ শ্রেণীকরণে যে ছাড় বছর শেষে কেন্দ্রীয় ব্যাংক দিয়েছে তা আরো বছরখানেক অব্যাহত রাখাটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।

চার. প্রবাস আয় বাড়াতে এ ক্ষেত্রে দেওয়া ২ শতাংশ নগদ প্রণোদনা ২০২২ সালে আরো ১ শতাংশ বাড়ানো যেতে পারে। পাশাপাশি ডলারমূল্যের উঁচু সুদের প্রবাসী ও অন্য বন্ডগুলো বর্তমানে যেভাবে আছে তা থাক। তবে এক কোটি টাকার ঊর্ধ্বসীমা তুলে দিয়ে সেসবের সুদের হার কমানো যেতে পারে। এর ফলে প্রবাস আয়ের প্রবাহ বাড়বে। ডলার-টাকা বিনিময় হার স্থিতিশীল হবে। টাকার মূল্যের ওপর যে চাপ রয়েছে তা কমে যাবে।

পাঁচ. মেগাপ্রকল্পগুলোর বাস্তবায়নের গতি আরো বাড়ালে প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান দুই-ই বাড়বে। পদ্মা সেতু ২০২২ সালের মাঝামাঝি চালু হলে দক্ষিণ বাংলার অর্থনীতির চেহারাই বদলে যাবে। জাতীয় অর্থনীতিতে ১ শতাংশেরও বেশি প্রবৃদ্ধি যুক্ত হবে। ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। প্রায় একই রকম স্বস্তি মিলবে ২০২২ ঢাকা শহরে মেট্রো রেল চালু হওয়ার পর।

ছয়. দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য আরো দ্রুত মিরসরাইয়ে বঙ্গবন্ধু শিল্প পার্ক, আড়াইহাজারে জাপানি অর্থনৈতিক অঞ্চলসহ মেগাপ্রকল্পগুলোর অন্তত কয়েকটি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে চালু করা গেলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রাণের জোয়ার আসবে। আমরা ডাবল ডিজিট প্রবৃদ্ধির পথে হাঁটতে থাকব।

তবে এসব স্বস্তি ও স্বপ্নপূরণে আমাদের অবিরাম মানুষের ওপর বিনিয়োগ করে যেতে হবে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক সুরক্ষা খাতে আমাদের সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়িয়ে যেতে হবে। বিশেষ করে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সুবিধা নেওয়ার মতো দক্ষ জনশক্তি তৈরি এবং উন্নত প্রযুক্তির প্রসারে আমাদের নিরন্তর মনোযোগী থাকতে হবে। একই সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য আমাদের সবুজ অর্থনৈতিক কৌশলকে আরো বেগবান করতে হবে।

সব শেষে সমাজকে দুর্নীতি ও সহিসংতামুক্ত রাখতে আমাদের সবাইকে আরো বেশি অঙ্গীকারবদ্ধ হতে হবে। সমাজে শান্তি বিরাজ করলে অর্থনীতিতেও বিনিয়োগ বাড়বে। আমাদের রয়েছে বঙ্গবন্ধু থেকে বঙ্গবন্ধুকন্যার গণমুখী নেতৃত্বের এক অসাধারণ পরম্পরা। আগামী দিনের বাংলাদেশ নিশ্চয় এই পরম্পরার সুফল পাবে।

লেখক : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক ও সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক